এবার সচিবদের নিয়ে বসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক বছরের বেশি সময় পর সচিবদের সঙ্গে সশরীরে বৈঠক করতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী । দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ একডজন বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকছে আলোচ্যসূচিতে। এ ছাড়াও বিবিধ প্রশাসনিক বিষয় আলোচনা হতে পারে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
সম্ভাব্য অন্যান্য আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে-বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনৈতিক সুসংহত রাখা, জ্বালানি নিরাপত্তা, প্রয়োজনীয়তার নিরিখে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, কৃষির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সারের জোগান নিশ্চিত করা ও পতিত জমি চাষের আওতায় আনা, সরকারি কাজে আর্থিক বিধিবিধান অনুসরণ করা, সরকারি সেবা প্রদানে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড, বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি, সুশাসন ও শুদ্ধাচার বিষয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বশেষ সচিবদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি বৈঠক করেন গত বছরের ১৮ আগস্ট। সে সময় মূলত করোনা বিষয় গুরুত্ব পেলেও খাদ্য পরিস্থিতি, বিদ্যুৎ পরিস্থিতি আলোচনায় অগ্রাধিকার পায়। এ ছাড়াও প্রশাসনে কাজের গতি আনা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন সঠিক সময়ে শেষ করার জন্য নির্দেশনা ছিল।
দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময়ের ব্যবধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার নিজেই সশরীরে উপস্থিত থাকছেন আগামী সচিব সভায়। বিশ্ব পরিস্থিতিতে আগামী দিনগুলো সরকারের জন্য কী ধরনের চ্যালেঞ্জ আসতে পারে তা তিনি সভায় আভাস দেবেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। তবে ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিশ্বমন্দা ও দুর্ভিক্ষের বিষয়ে কথা বলছেন। করোনা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সারা বিশ্বকে মন্দায় ফেলে দিতে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে খাদ্য পরিস্থিতি সচিব সভায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা আভাস দেন।
সর্বশেষ গত সোমবার মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দেন। ওই বৈঠকে তিনি খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেন। এ কারণে খাদ্য আমদানিতে উৎসে কর প্রত্যাহার করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে বিবেচনায় আনতে বলেছেন।
খাদ্য পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব অনুষ্ঠানে বেশি করে খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি পতিত জমিতে চাষ করার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশনা দিয়ে আসছেন। দেশে যেন কোনোভাবে খাদ্য সংকট না হয় প্রধানমন্ত্রী সেদিকেও নজর রাখছেন বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে। গত মন্ত্রিসভার বৈঠকে রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য বিদেশে দক্ষ জনবল পাঠানোর ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেন। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি ইতিমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। দেশে যেন কোনোভাবে আর্থিক কোনো সংকট সৃষ্টি না হয় সে ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংককে নজরদারি রাখতে বলেছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
সচিব সভায় অর্থনীতিতে সুসংহত করার জন্য বেশ কিছু নির্দেশনা দিতে পারেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কৃচ্ছ্রসাধন। রিজার্ভ ঠিক রাখা ও বাজেট সহায়তার জন্য ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৪৫০ কোটি ডলার ও বিশ্ব ব্যাংক আপাতত ২৫ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এখানে সরকারের জন্য বেশ কিছুটা স্বস্তি এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জ্বালানি নিরাপত্তা ও বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সচিব সভায় সাশ্রয়ের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে পারেন বলে আভাস পাওয়া গেছে। বর্তমান জ্বালানি পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট নিয়ে বেশ কিছু যুক্তি দিতে পারেন। পাশাপাশি এ বিষয়ে বেশ কিছু নির্দেশনা দিতে পারেন।
প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় নির্দেশনা দিয়ে থাকেন একনেক সভায়। এরপরও সচিব সভায় প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ব্যাপারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ব্যাপারে নির্দেশনা দিতে পারেন। কৃষির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সারের জোগান যেন নিশ্চিত করা হয় সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ইতিপূর্বে নির্দেশনা দিলেও আগামী সচিব সভায় কৃষি ও শিল্প মন্ত্রণালয়কে আবারও এ বিষয়ে নির্দেশনা দিতে পারেন।
সরকারি কাজে কোনো ধরনের শৈথিল্য না দেখানোর জন্য ইতিমধ্যে নির্দেশনা দিলেও আসন্ন সচিব সভায় এ বিষয়টি গুরুত্ব পেতে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি সরকারি কাজে আর্থিক বিধিবিধান অনুসরণ করার জন্য আবারও আলোচনায় আসছে। এ ছাড়াও সরকারি সেবা প্রদানে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার আরও বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হতে পারে।
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। এরপরও সবকিছু মোকাবিলায় করতে সরকার সিদ্ধহস্ত। তাই সচিব সভায় ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড, বন্যাসহ যেকোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির বিষয়ে আলোচনা হবে।
এদিকে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম কখনো অশান্ত আবার কখনো শান্ত। বান্দরবান সীমান্তে সশস্ত্র গ্রুপ দিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে মরণনেশা ইয়াবার কারবার। পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি নিয়ে সচিব সভায় আলোচনা হবে। এ ছাড়াও সুশাসন ও শুদ্ধাচার বিষয়টি আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত থাকছে আলোচ্যসূচিতে। আলোচনা প্রসঙ্গে আরও কিছু বিষয়ে আলোচনা হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
এদিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে বৈঠকের কার্যপত্র ১৭ নভেম্বরের মধ্যে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের কাছে পাঠানোর জন্য গত ১৪ নভেম্বর অনুরোধ করা হয়। সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পাঠানো কার্যপত্র থেকে প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করা হবে, যা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে বলে জানা গেছে।
নির্বাচন ইস্যুতে মন্তব্য করায় জাপানের রাষ্ট্রদূতকে ডেকেছিল মন্ত্রণালয় কূটনৈতিক প্রতিবেদক দেশের নির্বাচন ইস্যুতে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি গত সোমবার যে মন্তব্য করেছিলেন সে পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ডেকেছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জাপানের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কী বলা হয়েছে তা গণমাধ্যমে প্রকাশ করার প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বুধবার বলেন, ‘আসন্ন প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ক আরও গভীর হবে।’ কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার বিকালে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকিকে ডেকেছিলেন পররাষ্ট্র সচিব (সিনিয়র সচিব) মাসুদ বিন মোমেন। ওই দিন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় দুইজনের সাক্ষাৎ হয়। ওই সাক্ষাৎ সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে কেউই সাড়া দেননি।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম মঙ্গলবার একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে বলেন, ‘একাদশ ভোট অনুষ্ঠান নিয়ে জাপানের রাষ্ট্রদূত যে মন্তব্য করেছেন তার ব্যাখ্যা রাষ্ট্রদূতের কাছে জানতে চাওয়া হবে। কূটনীতিকরা শিষ্টাচার বহির্ভূত কোনো কাজ করলে সরকার কঠোর হবে।’
এই বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক এবং টুইটারে পোস্ট করেন। ওই পোস্টে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের অ্যাম্বাসেডরকে নির্বাচন ইস্যুতে মন্তব্য করায় জাপানের রাষ্ট্রদূতকে ডেকেছিল মন্ত্রণালয় ডেকেছিলাম। তাকে যা যা বলা দরকার আমরা বলেছি। সবকিছু বিস্তারিত গণমাধ্যমে বলার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। তাই এই বিষয়ে কোনো গণমাধ্যমে আমরা আর কোনো বক্তব্য দিতে চাই না। বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ক আরও গভীর হবে প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের আসন্ন বৈঠকের মধ্যে দিয়ে-এই প্রত্যাশায় আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এই সফর বাংলাদেশের এবং জাপানের সাধারণ মানুষের উপকারে আসবে বলে আশা করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘কেউ যদি ভুলে যান : কূটনৈতিক শিষ্টাচারসংশ্লিষ্ট ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের আর্টিক্যাল ৪১-এর-১ নম্বর প্যারা সম্মানের সঙ্গে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, সেখানে কোনো কূটনীতিককে গ্রহণ করা রাষ্ট্রের আইন ও বিধানকে সম্মান করার কথা বলা আছে এবং কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়েও পরিষ্কারভাবে বলা আছে।’
অন্যদিকে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকির মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বুধবার মেহেরপুরের মুজিবনগরে বলেন, ‘নির্বাচন ইস্যুতে কোনো দেশের হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া হবে না। নির্বাচন নিয়ে যারা মন্তব্য করছেন, তাদের সতর্ক করা হবে। শুধু জাপান নয়, কোনো দেশের রাষ্ট্রদূতের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া হবে না। এ বিষয়ে তাদের সতর্ক করা হবে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। এই দেশ কখনো কারও কাছে মাথা নত করবে না।’
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) এবং ফ্রেডরিক-এবার্ট-স্টিফটুং বাংলাদেশ (এফইএস, বাংলাদেশ)- এর যৌথ আয়োজনে ‘মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর’ সিরিজ শীর্ষক অনুষ্ঠানে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি গত সোমবার বলেন, ‘গত ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর জাপান দূতাবাস সহিংসতা নিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছিল, যা ছিল ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। কারণ জাপান কোনো দেশের নির্বাচনের পর বিবৃতি দেয় না। আমি শুনেছি, ওই নির্বাচনে পুলিশের কর্মকর্তারা আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করেন। আমি অন্য কোনো দেশে নির্বাচন নিয়ে এমন ঘটনার কথা শুনিনি। আমি আশা করব, আগামী নির্বাচনে এমন সুযোগ থাকবে না বা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।
শাহনেওয়াজ, সাংবাদিক