‘-উজ্জ্বল?
-হ্যাঁ।
-ওনারা কি টাকা-পয়সা চায়, টাকা-পয়সা দিতে হবে?
-হ, হ, হ।
-কয় টাকা চায়?
-অহনে, বাসায় যা আছে তাই দিতে হবে।
-কত দিমু, ক্যামনে দিমু, বিকাশে?
-না, না (সমস্বরে পাশ থেকে আরেকজনও বলেন একই কথা)।
তখন পাশ থেকে আরেকজন বলেন, নিয়ে আসবে, নিয়ে আসবে।
-আমি থানায় নিয়ে আসব, এই তো?
-…যদি হয় আসবেন, দেইখা যাইবেন। বাকিটার দায়-দায়িত্ব আমাদের।’
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর পরিবহন শ্রমিক ইমরান হোসেন হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এবং আসামি উজ্জ্বল মোল্লা ও তার স্বজনদের কথোপকথন এটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গত বৃহস্পতিবার উজ্জ্বল মোল্লাকে মৌলভীবাজার থেকে গ্রেপ্তার করে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। পরে তদন্ত কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার এসআই মুকিত হোসেন আসামির স্বজনদের ফোন দিয়ে অনৈতিক প্রস্তাব দেন। তিনি আসামিকে তাদের ‘হেফাজতে ভালো রাখার’ জন্য টাকা দাবি করেন। আসামির স্বজনরা তাকে ৪০ হাজার টাকা দেন। তিনি দাবি করেন ৫ লাখ টাকা। এই কথোপকথনের রেকর্ড রয়েছে।
গত ২৩ জানুয়ারি রাতে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী এলাকায় পরিবহন শ্রমিক ইমরান হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরদিন ওই নিহতের স্ত্রী পপি আক্তার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫০ নম্বর কাউন্সিলর মাসুম মোল্লাকে প্রধান আসামি করে ২২ জনের নামে মামলা করেন। উজ্জ্বল মোল্লা এজাহারভুক্ত দুই নম্বর আসামি। তার নেতৃত্বেই ওই হত্যাকাণ্ড হয় বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। এক নম্বর আসামি ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাসুম মোল্লা পলাতক। তিনি সম্পর্কে উজ্জ্বল মোল্লার মামাশ্বশুর।
কথোপকথনে শোনা যায়, এসআই মুকিত হোসেন শুরুতে কথা বলেন হত্যা মামলার আসামি উজ্জ্বল মোল্লার সঙ্গে। এরপর ফোন ধরিয়ে দেন ওই আসামির শাশুড়িকে। শুরু হয় তাদের কথোপকথন।
-হ্যালো
-উজ্জ্বল?
-হ্যাঁ, এখন কী করবি বল, কী সিদ্ধান্ত?
-তুই যা বলার, তুই আমারে বল, স্পষ্ট করে বল, হেজিটেশন করোস কেন, বল?
ওনারা কি টাকা-পয়সা চায়, টাকা-পয়সা দিতে হবে?
-হ, হ, হ।
-কয় টাকা চায়?
-অহনে, বাসায় যা আছে তাই দিতে হবে।
-কত দিমু, ক্যামনে দিমু, বিকাশে?
– না, না (সমস্বরে একই উচ্চারণ করতে শোনা যায় তদন্ত কর্মকর্তাকেও)। এর পরই উজ্জ্বল বলেন, কেমনে দিবা, বলব তোমারে। বলবে, কই আইবা-না আইবা, সব বলবে তোমারে।
তখন তদন্ত কর্মকর্তা পাশ থেকে বলেন, নিয়ে আসবে, নিয়ে আসবে। এর পরই উজ্জ্বল শাশুড়ির উদ্দেশে বলেন, তুমি নিয়ে আসবা।
-আমি থানায় নিয়ে আসব, এই তো।
-বলব, সব বলব, কী করতে হবে (পুলিশ কর্মকর্তার কণ্ঠস্বর)।
পাশ থেকে উজ্জ্বলের স্ত্রী বলেন, কোথায় দেখা করতে হবে জিগাও, কোথায় দেখা করতে হবে?
তখন তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, আমরা আপনাকে ফোন দিলে আপনি আইসেন। এর পরই লাইনটি কেটে দেওয়া হয়।
এর আগে ফোনের শুরুতে তদন্ত কর্মকর্তাকে বলতে শোনা যায়, আপনাকে আমরা হোয়াটসঅ্যাপে ফোন দিয়েছি এই কারণে যে, আমি উজ্জ্বলের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছি, আপনি ওর সঙ্গে কথা বইলা নেন। যদি হয় আসবেন, দেইখা যাইবেন। বাকিটার দায়-দায়িত্ব আমাদের।
ফোনের পুরো কথোপকথনের সময় গাড়ির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, উজ্জ্বল মোল্লাকে গ্রেপ্তারের পর ঢাকায় ফেরার পথে তদন্ত কর্মকর্তা উজ্জ্বলের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন এবং আসামিকেও কথা বলিয়ে দেন।
সূত্র বলছে, গত বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে উজ্জ্বলকে যাত্রাবাড়ী থানায় নিয়ে আসা হয়। এরপর তার স্ত্রী, এক সন্তান ও শাশুড়ি দেখা করেন উজ্জ্বলের সঙ্গে। এরপর থানা কম্পাউন্ডের নিচতলার একটি কক্ষে তদন্ত কর্মকর্তার হাতে তুলে দেওয়া হয় ৪০ হাজার টাকা। তদন্ত কর্মকর্তা রিমান্ড আবেদনে ‘শক্ত কিছু’ লিখবেন না বা রিমান্ড পেলেও ‘সমস্যা হবে না’ বলে আশ্বাস দেন। এদিকে তদন্ত কর্মকর্তা উজ্জ্বলের স্ত্রীর সঙ্গে মেসেঞ্জারে কিছু তথ্য আদান-প্রদান করেন। সেই রেকর্ডও রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার আসামি উজ্জ্বল মোল্লাকে আদালতে হাজির করে তিন দিনের রিমান্ডে নেন তদন্ত কর্মকর্তা মুকিত রহমান। এরপর ওই রাতেই আসামির স্বজনরা ফের তার সঙ্গে দেখা করেন। থানা কম্পাউন্ডের নিচতলার একটি কক্ষে তারা কথা বলেন।
সূত্র বলছে, সেখানে তদন্ত কর্মকর্তা তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কথা বলে আরও ৫ লাখ টাকা দাবি করেন। তা দেওয়া হলে রিমান্ডে আসামির কিছুই হবে না বলে তিনি জানান। এর পরই নতুন কিছু–ছুরি ও চাপাতি দেখিয়ে তিনি বলেন, টাকা না দিলে এগুলো উজ্জ্বলের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে বলে আদালতে জানানো হবে বলেও হুমকি দেন তিনি।
হত্যা মামলার আসামিকে পুলিশ হেফাজতে অবৈধ সুযোগ দিতে স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আদায় ও আসামির মোবাইল ফোনে কথা বলিয়ে দেওয়ার বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার এসআই মুকিত রহমানের সঙ্গে কথা বলা হয়।
তিনি আসামিকে বা নিজে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেননি বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘প্রশ্নই ওঠে না, সুযোগ নেই। ওই আসামি তিন দিনের রিমান্ডে আছে।’
তবে এই প্রতিবেদক তার সঙ্গে আসামির স্বজনদের কথোপকথনের কিছু তথ্য জানালে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘এগুলো আপনি কই পেলেন?’
পরে অবশ্য তিনি টাকা নেওয়া বা টাকা দাবির বিষয়ে অস্বীকার করলেও আসামি উজ্জ্বল মোল্লা স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন বলে জানান। তিনি বলেন, গ্রেপ্তারের পর আসামির স্বজনরা ফোন দিয়েছিলেন। তারা দেখা করতে চেয়েছেন। আমি তাদের নিয়ম মেনে দেখা করার কথা বলেছি। পরে তিনি এই প্রতিবেদককেও থানায় দাওয়াত দেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যাত্রাবাড়ী এলাকায় পরিবহনে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণের জেরে ইমরানকে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় উজ্জ্বল মোল্লাসহ এজাহারভুক্ত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলার প্রধান আসামি ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাসুম মোল্লা পলাতক।
সাবেক আইজিপি মো. নূরুল আনোয়ার বলেন, মামলার তদন্তে তথ্য পেতে ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে তদন্ত কর্মকর্তা হেফাজতে থাকা আসামিকে তাদের স্বজনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দিতে পারেন। এখানে অন্যায় কিছু হবে না। তবে তদন্ত কর্মকর্তা যদি অনৈতিক সুবিধা পেতে এ ধরনের কাজ করে থাকেন, তাহলে তা অন্যায় এবং বেআইনি।
পুলিশের সাবেক এ কর্মকর্তা বলেন, কোনো আসামি রিমান্ডে থাকলে তাকে নির্যাতন করা হবে না, এই বলে টাকা দাবি বা টাকা না দিলে নির্যাতন করা হবে এমন ভয়ভীতি দেখানোর কোনো সুযোগ আইনে নেই। এটা চরম অন্যায় আর তা যে বেআইনি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তিনি এও বলেন, হেফাজতে নিয়ে বা রিমান্ডে কাউকে নির্যাতন করাও আইন অনুমোদন করে না। কোনো তদন্ত কর্মকর্তার এ ধরনের কাজ করার সুযোগও নেই।
লেখক, সিনিয়র রিপোর্টার (ক্রাইম)
দৈনিক কালবেলা