আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার হচ্ছে বাংলাদেশেও৷ এমনকি দেশের বাইরেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মেশিন লার্নিং টুলস রপ্তানি হচ্ছে। ইন্টেলিজেন্ট মেশিনস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান কয়েক বছর ধরে তরুণদের নিয়ে এআই’র কাজটি করছে। এ খাতে এগিয়ে এসেছেন তরুণ উদ্যোক্তারা। বেসরকারি খাতে এর ব্যবহার বাড়ছে। পাশাপাশি সরকারি খাতও আধুনিক এই প্রযুক্তির আওতায় আসছে।
সম্প্রতি ডয়চে ভেলে এ নিয়ে কাজ করে। তারা দেখতে পেয়েছে,বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ, মোবাইল ফোন আপারেটর, ব্যাংক, অনলাইন ও কৃষিখাতসহ অনেক খাতেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা এমন দাবি করে বলেছেন,এর গ্রাহকও বাড়ছে৷
ইন্টেলিজেন্ট মেশিনস লিমিটেড-এর সিইও মো. অলি আহাদ জানান, এ মুহূর্তে তারা প্রায় ৪০ জনের একটি টিম কয়েকটি জায়গায় লার্নিং মেশিন টুলস দিচ্ছেন। তারাসফটওয়্যার এবং হার্ডওয়্যার দুই ক্ষেত্রেই কাজ করছেন।
তিনি জানান, ‘এআই যেকোনো বিষয়ে অনেক দ্রুত সময়ে সঠিক পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্ত জানাতে পারে। সাধারণ সফটওয়্যার তার প্রোগ্রাম অনুযায়ী কাজ করে। কিন্তু এআই ডাটার ভিত্তিতে নিজেই সেই সিদ্ধান্ত জানায়৷ হাজার হাজার ডাটা প্রসেস করে অনেক মানুষ অনেক সময় নিয়ে যে সিদ্ধান্ত দিতে পারে, এআই তা খুব অল্প সময়ে এবং অনেক বেশি নির্ভুল করতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যে-কোনো সেক্টরের জন্য কাজ করি৷ তবে ২০১৮ সালে বিকাশ দিয়ে আমাদের কাজ শুরু হয়৷ তাদের মার্কেটিং সিস্টেমকে আমরা এআই দিয়ে ডেভেলপ করি। অনেক কম জনবল দিয়ে তাদের মার্কেটিংকে আরো কার্যকর এবং দক্ষ করার ব্যবস্থা করি। কোনো সিস্টেম-লসও নাই৷ তখন তাদের এক লাখ ১৫ হাজার আউটলেটের জন্য মার্চেন্ডাইজার ছিল ৮২৪ জন৷ এখন পাঁচ লাখ ২৪ হাজারের চেয়ে বেশি অ্যাক্টিভ আউটলেটের জন্য মার্চেন্ডাইজার এক হাজার ১৪০ জন৷ তাদের বেতনও বেড়ে সাত হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকা হয়েছে। এআই বেতনের ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত দেয়৷ হিউম্যান সুপারভাইজারকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এআই সহায়তা করছে৷ কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে গেলে সে ভুলটাও বলে দিচ্ছে এবং সঠিকটাও জানিয়ে দিচ্ছে। এর জন্য তার প্রয়োজন হয় সঠিক ডাটা৷ আমাদের এখানে এখন সঠিক ডাটা পাওয়াই প্রধান চ্যালেঞ্জ।’
তিনি জানান, তারা কয়েকটি ব্যাংককেও সার্ভিস দিচ্ছেন৷ কোনো গ্রাহক ঋণ চাইলে তার তথ্য দিয়ে এআই তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়৷ ব্যক্তির ক্ষেত্রে হয়ত তথ্য কম। কিন্তু কোনো কর্পোরেট গ্রাহক হলে তার ডাটা হতে পারে কয়েক হাজার পৃষ্ঠা৷ সেটা বিশ্লেষণ করা হিউম্যানলি অনেক সময়সাপেক্ষ। কিন্তু এআই তা খুব অল্প সময়ে করে দিচ্ছে।
তিনি আরও জাানন, ‘মোট ১০টি প্রতিষ্ঠান আমাদের ক্লায়েন্ট। বাংলাদেশে পাঁচ এবং ইউএসএ, অষ্ট্রেলিয়া এবং মিয়ানমারে আমরা কাজ করছি এখান থেকেই৷ বাংলাদেশের পাঁচটির মধ্যে চারটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং একটি বহুজাতিক কোম্পানি৷’
কৃষি ও শিল্প খাতে ব্যবহার:
তরুণ উদ্যোক্তা পরাগ ওবায়েদের নেতৃত্বে একাধিক এআই প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। তাদের পুরো কাজটিই মেশিন লার্নি। তারা টেলকো এবং কৃষি খাতে কাজ করছেন৷ তারা সফটওয়ার এবং হার্ডওয়্যার- দুইটি নিয়েই মেশিন লার্নিয়ের কাজ করেন। তিনি জানান, ‘আমরা পানি, মাটি, কৃষি ও কৃষকের ব্যাপারে এআই ব্যবহার করে সঠিক উৎপাদন চাষ-পদ্ধতির ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত দিচ্ছি। বিএডিসির সোলার পাম্পে আমরা মেসিন লার্নিং ডিভাইস বসিয়ে ডাটা নিয়ে পাম্পের সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করছি৷ সঠিক সময়ে কতটুকু জলসেচ দরকার এইসব সিদ্ধান্ত দিচ্ছে এআই।’
তিনি জানান, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সহায়তা নেয়ার বাইরেও যে প্রতিষ্ঠানের দরকার তারাও এখন নিজেরাই এআই ডেভেলপ করছে।
আইওটি ডিভাইস বাংলাদেশেই
অ্যাকুয়ালিংক-এর সিইও সৈয়দ রিজওয়ান বলেন, আমরা কোয়ালিটি মনিটরের এআই নিয়ে কাজ করি।সেটা যেকোনো প্রডাক্ট হতে পরে৷আমরা একটি আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংকিং) ডিভাইস তৈরি করেছি, যার নাম সেন্সোমিটার৷এই ডিভাইস দিয়ে এটা করা যায়৷ এটা রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে একটি কারখানার পরিবেশ, বাতাসের আর্দ্রতা সব কিছুই দেখতে পারে।’
তিনি জানান, তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বীজের জন্য একটি গ্রিন হাউজ করে দিয়েছেন, যেটা তাদের ডিভাইস দিয়ে নিয়ন্ত্রণ এবং কোয়ালিটি কন্ট্রোল করা হয়। সেখানে টেম্পারেচারসহ সব কিছু ডিভাইস সয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে৷
তিনি বলেন, ‘এআই মাটির গুণাগুণ রিসার্চ করে বলে দেবে কোন ধরনের ফসল ওই মাটিতে চাষ করা উচিত৷ কিন্তু সমস্যা হলো, পর্যাপ্ত ডাটা আমাদের এখানে নেই৷ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে (আরএনডি) এটাই প্রধান বাধা এখন।’
তার কথা, ‘এটার জন্য খুব অর্থের প্রয়োজন হয় না৷ প্রয়োজন হয় দক্ষতা এবং সব সময় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়ার দক্ষতা। আমরা এখন তেমন লাভ করতে পারছি না৷ লোকসানেও নেই৷ তবে চাহিদা বাড়ার পাশাপাশি মানুষও জানছে।’
তিনি জানান, তরুণদের যারা এআই নিয়ে কাজ করছে, তাদের অধিকাংশই বেসিসের অধীনে কাজ করছে।
নেতৃত্বে তারুণ্য
জেমস বন্ড এবং আইনস্টাইনের নাম মিলিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম বন্ডস্টেইন টেকনোলজিস লিমিটেড। এর কো-ফাউন্ডার শাহরুখ ইসলাম জানান, তারা এআই এবং আইওটি দুটি নিয়েই কাজ করছেন। বিশেষ করে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে তাদের ক্লায়েন্ট বেশি৷ তারা কৃষিখাতেও কাজ করেন।
তিনি বলেন, ‘শিল্প কারখানা তাদের অপচয় কমাতে চায়। মেশিনের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে চায় এবং ব্যয় কমাতে চায় দক্ষ ম্যানেজমেন্টের মাধ্যম। এইসব আমরা করে দিচ্ছি এআই এবং আইওটির মাধ্যমে৷’
তিনি বলেন, প্রতিদিনই ক্লায়েন্ট বাড়ছে৷ অনেকে জানেন না৷ যখন জানছেন তখন আগ্রহ দেখাচ্ছেন৷ আমাদের কোনো প্রচার বা বিজ্ঞাপন নেই। কাজের মধ্য দিয়েই চাহিদা বাড়ছে৷সরকারের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে সব দপ্তরকে টেকনোলজি ব্যবহারে জোর দিতে হবে৷এটা আমাদের সহায়তা করছে।’
বিতর্ক আছে এআই এবং আইওটি মানুষকে বেকার করবে কিনা৷ তারা মানুষের জায়গা দখল করবে কিনা এমন প্রশ্নও করেন অনেকে৷এর জবাবে শাহরুখ ইসলাম বলেন, ‘১৮ কোটি মানুষের এই দেশে সব কিছু ম্যানুয়ালি করা সম্ভব নয়। আমাদের আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করতেই হবে। আসলে এর ব্যবহার অপচয় কমাবে৷ সঠিক উপায়ে কাজ করা নিশ্চিত করবে৷ ফলে নতুন ধরনের কর্মসংস্থান হবে এবং উৎপাদনও বাড়বে ৷’
অলি আহাদ বলেন, ‘এটা শিক্ষা, সাংবাদিকতা সব ক্ষেত্রেই কাজে লাগছে৷ একটি ছেলে কোন বিষয়ে ভালো করবে তাও এআই বলে দিচ্ছে৷ কিন্তু এটা তো মানুষেরই সৃষ্টি- এটা মনে রাখতে হবে। সে কখনো মানুষকে বিদায় করতে পারবে না।’
বেসিস ছাড়াও বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল, সরকারের এটুআই প্রকল্পসহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠান এআই এবং আইওটি নিয়ে কাজ করতে উৎসাহ ও সহায়তা দিচ্ছে।
চীনা রোবটের প্রোগ্রামিং
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এক সময় বেসিসের সভাপতি ছিলেন। তিনি বলেন, ‘তরুণরা এই সময়ে অনেক কিছু পাল্টে দিচ্ছে৷ তারা এআই এবং আইওটি নিয়ে কাজ করছে৷ তাদের প্রয়োজন সহযোগিতা৷সহযোগিতা মানে তাদের অর্থ ঢেলে দিতে হবে তা নয়, তাদের কাজের পরিবেশটা দিতে হবে। আমরা সেটা দেয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশকে নিয়ে যে উদ্ভট ধারণা নিয়ে মানুষ চলতো, আমি মনে করি ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত সেই ধারণার উল্টোটা হচ্ছে। আমাদের এখানকার ছেলে-মেয়েরা যত নতুন প্রযুক্তি আছে, তার প্রত্যেকটি নিয়ে কাজ করছে। আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ মেলায় চীনা কোম্পানি যে রোবট এনেছে তার প্রোগ্রামিং করেছে বাংলাদেশের তরুণরা৷ আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর এই প্রযুক্তিতে পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য যা যা করা দরকার তা-ই করেছেন।’
এই প্রযুক্তি মানুষের বিকল্প হবে এমন আশঙ্কা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন অনেকে বলছেন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কথা। আমরা বলি পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের কথা৷ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে আমি বিশ্বাস করি না৷ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ধারণা হলো মানুষকে যন্ত্র দিয়ে রিপ্লেস করা৷ আর পঞ্চম শিল্প বিপ্লব হলো যন্ত্রকে মানুষের করায়ত্ব করা। আমরা মনে করি, মানুষ যন্ত্র বানাবে, নিয়ন্ত্রণ করবে এবং মানুষের জন্যই কাজ করবে সেই যন্ত্র।