গত কয়েক বছরে গাড়ির দাম এতোটা বেড়েছে, যার ফলে বিক্রিতেও হয়েছে নাটকীয় পতন।বাংলাদেশের মধ্যবিত্তদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্র্যান্ড হচ্ছে– টয়োটা এলিয়ন ও প্রিমিও। কিন্তু, ২০১১ সালে এসব গাড়ি উৎপাদন বন্ধ করেছে টয়োটা। ফলে নিলাম বাজারে এগুলোর দামও বেড়ে গেছে।
মোটরকার নিয়ে বিস্তর আগ্রহ ও জানাশোনা আছে সৈকত রায়ের। ২০১৯ সালে তাঁর পরিবার সাড়ে ২২ লাখ টাকায় একটি টয়োটা অরিস কেনে। সৈকত বলেন, “কিন্তু, পাঁচ বছরের পুরোনো মডেলের (রিকন্ডিশন্ড কার) হাইব্রিড গাড়িটি বর্তমানে ৩৩ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।”
সৈকত রায় বলেন, ২০১৯ সালে এসব গাড়ির দাম শুরু হতো প্রায় ৩০ লাখ টাকা থেকে। গ্রেড ও অন্যান্য আনুষাঙ্গিকের খরচ মিলে এটা ৪০ লাখ টাকায় পৌঁছতে পারে। কিন্তু, এখন দামই শুরু হয় ৪০ লাখ টাকা থেকে। একটু কমে ৩৭ থেকে ৩৮ লাখ টাকা দিয়েও আপনি সহজে কিনতে পারবেন না।
তিনি বলেন, সবকিছু ধরে এখন দাম সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা হতে পারে। “আমাদের যে টয়োটা প্রিয়াস কার আছে আগে সেটার দাম শুরু হতো ২২ লাখ টাকায়, কিন্তু এখন ২৫ লাখ টাকার নিচে পাবেন না।”
দেশে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির আমদানিকারক ও ডিলারদের সংগঠন- বারভিডা’র দেওয়া সাম্প্রতিক তথ্যে জানা গেছে, ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে সার্বিকভাবে ৪৪ শতাংশ অটোমোবাইল বিক্রি কমেছে। মোটরকারের দাম চড়া হওয়া এবং সেকারণে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির গাড়ি কেনার সামর্থ্য নিয়ে একারণে আবারো প্রশ্ন উঠছে।
বারভিডার তথ্যমতে, বাংলাদেশের মধ্যবিত্তদের অধিকাংশই যা কেনেন– সেই রিকন্ডিশন্ড কারের বিক্রিতে সবচেয়ে বড় পতন হয়েছে। আর সেজন্যই প্রশ্ন উঠছে, মধ্যবিত্তদের একটি মোটরকার কেনার স্বপ্ন কতোটা প্রভাবিত হয়েছে, এবং কী অবস্থাতেই বা তাঁরা রয়েছেন? তাছাড়া, দাম বাড়ার এই ধাক্কাই বা কীভাবে মোকাবিলা করছে গাড়ির বাজার?
গবেষণা ও নীতিসহায়ক সংস্থা– ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএফ) নির্বাহী পরিচালক এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এর সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কামাল মুজেরী বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অর্থনীতির স্বাভাবিক ছন্দপতন হয়েছে। যেকারণে চড়া মূল্যস্ফীতি, ডলারের দাম বাড়া এবং সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যান্য সমস্যা মাথাচাড়া দিয়েছে।
তিনি বলেন,”গত দুই বছর ধরেই অর্থনীতিতে এসব সমস্যা ছিল, যা এখন তীব্র হয়ে উঠেছে। বিশেষত, উচ্চ মূল্যস্ফীতি আগে কখনোই এতদিন অব্যাহত থাকেনি”
“ঢাকার মতো শহরে যেখানে গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা ও দুর্ভোগ, সেখানে চলাচলের জন্য কার থাকা একটি প্রয়োজনীয়তার মধ্যে পড়ে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মধ্যবিত্তরা গাড়ি কিনতে চাইতেন। কিন্তু, মূল্যস্ফীতির কারণে তাঁদের পক্ষে এই ইচ্ছেপূরণ করাটা এখন সাধ্যের বাইরে।”
মুজেরী আরও বলেন, “রিকন্ডিশন্ড বা সেকেন্ড হ্যান্ড মোটরকারের বড় ক্রেতা হলেন মধ্যবিত্তরা। মূলত একারণেই এ ধরনের গাড়ির বিক্রিবাট্টা ব্যাপকভাবে কমেছে।”
রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় কাজী মোটরস ব্যবহৃত মোটরকার বিক্রি করে। প্রতিষ্ঠানটির একজন নির্বাহী কর্মকর্তা মিঠু বলেন, দাম বাড়ার ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাঁদের গাড়ি বিক্রি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, “আমাদের সংকট হচ্ছে পুরোনো কার ডিলাররা এমনভাবে দাম বাড়াচ্ছেন, যে দামে কিনে আমরা বিক্রি করতে পারি না। ফলে বিক্রির জন্য যথেষ্ট গাড়িও পাচ্ছি না।”
“আমাদের কাস্টমার ব্যাপকভাবে কমে গেছে। আগে যে গাড়ির দাম ১০ লাখ টাকা চাইতাম, এখন আমাকে তার দাম ১২ লাখ টাকা চাইতে হচ্ছে। যেকারণে স্বাভাবিকভাবেই ক্রেতা কমে গেছে”- যোগ করেন তিনি।
কাজী মোটরসে গাড়ি কিনতে এসেছিলেন প্রকৌশলী অমলেন্দু দাস। ১৩ লাখ ২০ হাজার টাকায় ২০০৮ মডেলের একটি পুরোনো টয়োটা রাশ কেনেন তিনি। কথা হয় তাঁর সঙ্গেও।
যে দামে কিনতে চেয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি দামে কিনতে হলো কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে অমলেন্দু বলেন, “আমার যে টার্গেট ছিল– তারমধ্যে এই গাড়িটি কিনতে পারিনি। কিন্তু, সবকিছু তো আর ইচ্ছেমতো হয় না। বাজারে এখন যেভাবে গাড়ির দাম বাড়ছে- তাতো জানেনই। তাই যদি বাজেটে কুলায়– তাহলে কিনব, নাহলে কিনব না। মোটরকার তো আর মেডিসিন না, যে না খেলে জীবন নিয়েই টানাটানি হবে। আমার সাধ্যের মধ্যে না থাকলে, গাড়ি চালাব না। আমার হিসাব খুব সোজা।”
কাছাকাছি আরেকটি গাড়ির দোকান– এসএ কার সেন্টার। এ প্রতিষ্ঠানের সামনে আমরা অপেক্ষা করেছিলাম কোনো ক্রেতা এলে তার সাক্ষাৎকার নিতে। কিন্তু, বেশকিছুক্ষণ অপেক্ষার পরেও কাউকেই পাওয়া গেল না। এসএ কার সেন্টারের শরীফ তখন জানালেন, করোনা মহামারির পর থেকেই গাড়ির দাম নাটকীয় হারে বেড়ে গেছে।
শরীফ আরো বলেন, মধ্যবিত্তরা কেনেন এক্সিও, এক্সিও ফিল্ডার, এলিয়ন, প্রিমিও ইত্যাদি। সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ির ক্ষেত্রে এগুলোর দাম আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা বেড়েছে। ২০১৪ মডেলের এক্সিও’র কথাই ধরুন, কিছুদিন আগে আমরা একটা ১৯ লাখ টাকায় বিক্রি করছি। কিন্তু, বেশিদিন আগের কথা না, যখন ১৬ থেকে ১৭ লাখে বিক্রি করতাম”
বারিধারার জুম অটোজের একজন সিনিয়র নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ স্বপনের বলেন , গত দুই বছরে কার বাজারে অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
তিনি বলেন, যখন ডলারের দাম বাড়ে, আমাদের পণ্যের দামও বেড়ে যায়। আগে এক ডলার ৮০ টাকায় কিনতে হতো, এখন কিনতে হচ্ছে ১২০ টাকায়। টাকার হিসাবে তখন আমদানি মূল্য বেশি হওয়ায়– আমদানি করও বেড়ে যায়।
“ধরুন আগে আপনি এক ডলারে (৮০ টাকায়) একটি গাড়ি কিনতেন। এখন সেই একই জিনিস কিনতে লাগছে ১২০ টাকা। এতে শুরু গাড়ির দামই বাড়ছে না, বরং তার সাথে আপনাকে করও বেশি দিতে হচ্ছে। ফলে দুই দিক থেকেই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।”
স্বপন জানান, বাজেটের মধ্যে থাকলে মধ্যবিত্তরা রিকন্ডিশন্ড টয়োটা এক্সিও বা এক্যুয়া কিনতে পছন্দ করেন। ২০২০ সাল পর্যন্তও এসব গাড়ির দাম সাড়ে ১৩ থেকে ১৪ লাখ টাকা ছিল।
“করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পরে অনেকের এখন ব্যবসায় ধস নামে, অনেকে চাকরি হারান। তাই বাজারেও দেখা দেয় মন্দাভাব। অনেকে এই ব্যবসাই ছেড়ে দেয়। এরপর যখন বাজার কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরে, তখন আবার গাড়ির দাম বেড়ে যায়”- ব্যাখ্যা করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন “সুদহার হয়তো কিছুটা কমানো হয়েছে, কিন্তু কার লোন সংশ্লিষ্ট জটিলতা বেড়েছে। মধ্যবিত্তদের হাতে তো আর প্রচুর নগদ টাকা থাকে না। এজন্য গাড়ি কেনার আগে তাঁদের অনেক চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। যার ফলে, কার বিক্রিও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। সত্যি বলতে কি, রিকন্ডিশন্ড হোক বা ব্র্যান্ড নিউ– এক শ্রেণির মানুষ কার কেনার ইচ্ছা একেবারে ছেড়েই দিয়েছেন”-
অবশ্য সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ির দাম বাড়ার কোনো যুক্তি নেই বলেই মনে করেন গাড়ি ক্রেতা অমলেন্দু। তাঁর মতে, ডলার সংকট বা এলসি খোলার সমস্যায় রিকন্ডিশন গাড়ির দাম বাড়তেই পারে, কিন্তু তাই বলে পুরোনো গাড়ির দাম কেন বাড়বে!
হতাশ কণ্ঠে তিনি বলেন, “আসলে বিক্রেতাদের একটা সিন্ডিকেট আছে। তাঁরা বলতে চাইছেন, রিকন্ডিশন্ড গাড়ি কিনতে এতবেশি টাকা খরচ না করে, দুই-তিন লাখ টাকা বেশি দিয়ে সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়িই কেনেন।”
বাংলাদেশ লাক্সারি কার ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএলসিআইএ)-র একটি তথ্যে অবশ্য পাওয়া যায় বিস্ময়কর এক চিত্র। যেটি জানাচ্ছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ-বেঞ্জ, অডি ও লেক্সাসের মতো বিলাসবহুল মোটরকার বিক্রি বেড়েছে ৩০০ শতাংশ।
ড. মুজেরী বলেন, মধ্যবিত্তরা যখন তাঁদের সাদামাটা স্বপ্নটাও পূরণ করতে পারছেন না, তখন এই তথ্য বাংলাদেশে সম্পদের ব্যাপক বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেছে।
তিনি আরো বলেন, “এতে দেখা যাচ্ছে, আমাদের সমাজে এক শ্রেণির মানুষ এত বেশি সম্পদের মালিক হয়েছেন যে, মূল্যস্ফীতি বা সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যান্য প্রতিকূলতার আঁচ তাঁদের গায়ে লাগে না। তাঁরা সম্পদ প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা করেন। এই প্রতিযোগিতা অনেকদিন ধরেই চলছে, এবং ভবিষ্যতেও চলবে”।
(এইদিনএইসময় /জাকারিয়া শুভ)