২২ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবার

অনিন্দিতার গল্প…

মঈন চৌধুরী
spot_img
spot_img

অনির ভাল নাম ছিল অনিন্দিতা ভট্টাচার্য।সে ছিল আমার ছেলেবেলার খেলার বন্ধু। আমি, আমার বোন, অনি আর অনির ভাই অরূপ প্রতিদিন একসাথে খেলতাম। আমি আর অরূপের বয়স ছিল দশ, অনি আর আমার বোনের ছিল সাত কি আট। একসাথে খেলতে খেলতে আমার বয়স যখন ১৮ আর অনির ১৬ তখন আমাদের মাঝে এক ধরণের ‘ভাললাগা’-র অনুভুতি এসেছিল, যাকে আমরা ভালবাসা বা প্রেম ভাবতে পারতাম না। তার কারণ ছিল তখনকার সমাজ। একটা হিন্দু মেয়ে আর একজন মুসলিম ছেলে যে ভাললাগার গন্ডি পেরুতে পারে না তা আমরা বেশ ভাল করেই বুঝতাম। সব বুঝে আমাদের মনস্তাত্ত্বিক অনুভূতি আর প্রকাশকে মায়া আর ভাললাগাতেই আটকে রেখেছিলাম।

১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তানের অনেক হিন্ধুই ভারতে চলে যায়। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হই, তখন অনিরা ভারতের শিলিগুরিতে মাইগ্রেট করে। অনি তখন ইডেনে পড়তো। ভারতে যাবার আগে অনি আর অরূপ আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল।মন খারাপ করে তাদের বিদায় দেবার সময় খেয়াল করেছিলাম, অনি চাপাকান্নায় কাঁদছে।

শিলিগুরি থেকে অরুপ আর অনি মাঝেমধ্যে আমাকে চিঠি লিখতো। অনি শিলিগুরি কলেজে সাইন্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিল, তার ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হবার। আমি খুব খুশী হয়েছিলাম।

সময়ের সাথে সাথে আমাদের যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। আমি যখন থার্ড ইয়ারে পড়ি, তখন অরূপ লিখেছিল, তার বাবা মা জোর করে অনিকে শিলিগুড়ি রেইলওয়ের এক সিনিয়র ম্যাকানিকের সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। খবরটা শুনে আমি কেন যেন অসম্ভব দুঃখ পেয়েছিলাম। অনি আর কোনদিন লিখেনি, শুনেছিলাম অরূপ জলপাইগুরিতে এক প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করছে।

তারপর বহুবছর কেটে গেছে। অনি আর অরূপের কথা প্রায়ই মনে আসলেও, যোগাযোগ ছিল না। আমিও আমার ঢাবি-পর্ব শেষে বিদেশে পড়াশোনা করে, আমার ইঞ্জিনিয়ারিং উপদেষ্টার কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলাম। বাড়তি কাজ হিসেবে করতাম লেখালেখি, ছবি আঁকা, ভাস্কর্য গড়া, বনসাই করা আর বাগান সাজানো। ঘরে ছিল ভালবাসার জীবন সাথী, ছেলে আর মেয়ে। জীবন সুখের ছিল, তবু বিষন্ন নস্টালজিয়ার অংশ হিসেবে মনে পড়তো অনি, অরূপ, নিরঞ্জন, সাহাব, সাত্তার সহ অনেক প্রিয় বন্ধুদের।

একবার সাহিত্য করতে কোলকাতায় গিয়ে নিরঞ্জনের সাথে দেখা করলাম। সে যেহেতু অরূপ আর অনির ঘনিষ্ঠ ছিল, তাই জানতে চাইলাম অরূপ আর অনির কথা। নিরঞ্জন বিমর্ষ হয়ে তাদের গল্প বললো। গল্পটা মনে কষ্ট নিয়ে আমিও বলছি।

অনির বিয়ের কিছুদিন পরে কলেরা হয়ে মারা যায় অনির বাবা আর মা। অরূপ চলে যায় জলপাইগুড়ি মাস্টারি করতে। এদিকে অনির জীবন ছিল খুবই কষ্টের। তার বর ছিল এক মদ্যপ জুয়ারি। একসময় লিভার সিরোসিস হয়ে মারা যায়। অনি তখন শিলিগুড়ির রেইলওয়ে কলোনির বিভিন্ন বাসায় রান্নার বুয়া হিসেবে কাজ করে জীবন যাপন করতো। তার একটা ছেলে ছিল, নাম অশোক। আঠারো বছর বয়সে সে কাজের খোঁজে মুম্বাই চলে যায়। কাজ করতো এক সিনেমা কোম্পানির লাইট-বয় হিসেবে। মায়ের খোঁজ কদাচিত নিলেও মায়ের জন্য তার আন্তরিকতা ছিল না। অনি একসময় শিলিগুড়ি ছেড়ে কোলকাতায় চলে আসে অত্মীয় স্বজনের সংস্পর্শ পাওয়ার আশায়। থাকতো লেকটাউনের কাছে এক বস্তিতে, কাজের বুয়ার কাজ করতো বিভিন্ন বাসায়। কিন্তু এই অল্প সুখও তার কপালে লেখা ছিল না। একদিন ভোরে কাজে যাবার সময় অনি গাড়ি চাপা পড়ে মারা যায়।

অনি আমার ছেলেবেলার খেলার সাথী ছিল, একটু বড় হবার পর হয়েছিল ভাললাগা আত্মার বন্ধু। কিন্তু অনির মরে যাওয়ার খবর শুনে মনে হয়েছিল, আমি অনির আত্মাকে ভালবাসি।

লেখক- মঈন চৌধুরী

কবি, প্রবন্ধকার, ভূপ্রকৌশলী।

সর্বশেষ নিউজ