ছাত্র লীগের কর্মসূচিতে অংশ না নেয়ায় জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আবাসিক শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে।
একই সঙ্গে ওই শিক্ষার্থীকে হল ছাড়ার নির্দেশও দিয়েছেন নেতাকর্মীরা।
কুষ্টিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ফুলপরীকে নির্যাতনের ঘটনার রেশ না কাটতেই জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনায় ছাত্রসমাজ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ।
ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যোগ না দেয়া ছাড়াও গেস্টরুমে অনুপস্থিত থাকা এবং বিভিন্ন সময়ে সিনিয়রদের নির্দেশ না মানায় এমন নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী।
পরিসংখ্যান বিভাগের ৪৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী ভুক্তভোগী সাকিবুল ইসলাম ফারাব্বি জানান, গত বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাত দুইটায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ২১৯ নম্বর কক্ষে এই নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ইতোমধ্যে তিনি সংশ্লিষ্ট হল প্রভোস্ট বরাবর ‘ছাত্রলীগের কর্মী দ্বারা নির্বিচারে মারধরের জন্য বিচার চেয়ে আবেদন’ শীর্ষক অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন।
অভিযুক্তরা সবাই শাখা ছাত্রলীগের কর্মী এবং সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেলের অনুসারী বলে জানা গেছে।
নির্যাতনের বিষয়ে তিনি বলেন, “সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা চলমান থাকায় আমি কয়েকটি পলিটিক্যাল কর্মসূচিতে যোগদান করতে পারিনি। গেস্টরুমেও অনিয়মিত ছিলাম। ভাইদের দৃষ্টিতে বিভিন্ন ফল্ট করায় গতকাল (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাত ২ টার দিকে হলের ৪৮ ব্যাচের সিনিয়ররা আমাকে ২১৯ নম্বর কক্ষে ডাকে।
একসময় তারা আমাকে হল ছাড়তে নির্দেশ দেয়। আমি হল ছাড়তে দ্বিমত পোষণ করি। পরে তারা আমাকে শার্ট-প্যান্ট খুলতে বলে। আমি শার্ট-প্যান্ট না খোলায় তারা আমাকে বারবার তেড়ে মারতে আসতে থাকে। একপর্যায়ে সবাই মিলে আমাকে মারধর করে। এসময় ৪৯ ব্যাচের বন্ধুরা আমাকে সেই রুম থেকে আমার ২১৬ নম্বর কক্ষে নিয়ে আসে।”
ঘটনার সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রেসিডেন্ট ব্লকের ৪৮তম ব্যাচের প্রায় সব ছাত্রলীগ কর্মী উপস্থিত ছিলেন বলে জানান তিনি। তবে নির্যাতনে লিড দিয়েছেন জুনায়েদ হাসান রানা (ইংরেজি ৪৮), নাইমুল ইসলাম সাগর (ফার্মাসি ৪৮), আতিক শাহরিয়ার ( ইতিহাস ৪৮), মোহতাসিম বিল্লাহ (চারুকলা-৪৮), উৎস (সরকার ও রাজনীতি ৪৮), কাব্য (সরকার ও রাজনীতি ৪৮), জুনায়েদ ইভান (গণিত ৪৮), ইমরান মির্জা (বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি- ৪৮), সৈকত ইসলাম (পদার্থবিজ্ঞান -৪৮)।
এদিকে অভিযুক্তদের সবাই মারধর ও হল ত্যাগের নির্দেশের বিষয় অস্বীকার করেছেন। এ ব্যাপারে অভিযুক্তদের একজন মোহতাসিম বিল্লাহ বলেন, ‘আমি ২২৮ নম্বর রুমে থাকি। হলে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। আরেক অভিযুক্ত উৎস বলেন, ‘অভিযোগকারী ফারাবি চরম মাত্রায় নেশা করে থাকে। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। কাউকে মারধর করা হয়নি।
এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না দাবি করে অভিযুক্ত জুনায়েদ হাসান রানা বলেন, ‘আমি ছিলাম না ওই খানে। আমি ২১৯ নম্বর রুমেই থাকি। রাতে হলেই ছিলাম, তবে ওই ব্যাপারে কিছু জানি না।’
অভিযুক্তদের আরেকজন ও ফার্মাসি বিভাগের নাইমুল ইসলাম সাগরের ভাষ্য, শুধু ফারাব্বি না, ৪৯ ব্যাচের কয়েকজনকেই ২১৯ এ ডাকা হয়েছিল। তার দাবি, তাদেরকে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলা হয়েছে। তারপর তাদেরকে চলে যেতে বলা হয়েছে। কারও গায়ে কোনো স্পর্শ করা হয়নি। তিনি বলেন, এসময় ৪৮ ব্যাচের সবাই ছিল। জুনায়েদ হাসান রানাও উপস্থিত ছিল। তবে, কোনো মারধর করা হয়নি।’
হল থেকে নেমে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হল থেকে নেমে যাওয়া নয়, আমাদের ৪৮-৪৯ এর একটি চ্যাটগ্রুপ আছে। সেখানে ফারাবি ‘কিরে মুরগিরা কথা বলস না কেন?’ লিখেছিল। গ্রুপে ৪৮ এর সিনিয়ররা ছিল, তারা এই ব্যবহারে মাইন্ড করে। সে হয়তো বুঝে নাই সিনিয়ররা সেই গ্রুপে আছে। সিনিয়রসহ সবাইকে ‘মুরগি’ লেখায়, তাকে আপাতত নিচতলার একটি রুমে যেতে বলা হয়েছিল। রুম শাফল করা হচ্ছে তাই আর কী। যদি আবার সিনিয়রদের সঙ্গে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যায়, তখন আবার ওপরে চলে আসবে এমনটা বলা হয়েছে।
প্যান্ট-শার্ট খুলতে বলা হয়েছে কিনা? এই প্রশ্নের জবাবে সাগর বলেন- “সেভাবে শার্ট-প্যান্ট খুলতে বলা হয়নি। ফারাবির শার্টের ওপরের বোতাম খোলা ছিল। তাই সিনিয়ররা বলেছে একটা বোতাম খোলা রাখবি কেন? খুললে সবগুলা খোল, নইলে সবগুলা বন্ধ কর।
সাকিবুল ইসলাম ফারাব্বিকে মারধরের তথ্য অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমরা নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে কথা বলেছি। কাউকে কোনো প্রকার গায়ে হাত তোলা হয়নি।’
তবে অভিযুক্তরা মিথ্যা বলছেন জানিয়ে ভুক্তভোগী ফারাব্বি বলেন, ‘আমাকে রানা ভাই, বিল্লাহ ভাই, আতিক ভাই লাঠি দিয়ে মারছে। আর কাব্য, সৈকত ভাইয়েরা আমাকে হাত দিয়ে মারছে। যে যেভাবে পারছে আমাকে মারছে।’
ভুক্তভোগী আরও বলেন, “এ ঘটনার পর আমি মুঠোফোনে সেদিন রাতেই হল প্রভোস্টকে বিষয়টি অবগত করেছি। সমাবর্তনে ব্যস্ত থাকায় হল প্রভোস্ট আজ লিখিত অভিযোগপত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সে অনুযায়ী অভিযোগপত্র জমা দিয়েছি।”
মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আর-রাফি চৌধুরী বলেন, ‘মারধরের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। তাকে যদি মারধর করা হয় তাহলে তো শরীরে দাগ থাকবে। ফারাব্বি একধরনের সিনথেটিক টাইপের ড্রাগ নেয়। এটা নিয়ে ৪৮ ব্যাচ হয়তো তাকে বুঝাইছে, এমনও হতে পারে। হল-ত্যাগের আদেশের ব্যাপারে তিনি বলেন, ফারাব্বি তো এখনো হলেই আছে। তাই না।
শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেল বলেন, র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ জিরো-টলারেন্স ঘোষণা করেছে। যদি অভিযোগের সত্যতা মেলে, তাহলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী ক্যাম্পাসে আমরা একটি র্যাগিং বিরোধী সচেতনতা ক্যাম্পেইন চালাব।”
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. নাজমুল হাসান তালুকদার বলেন, আমি একটি অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে। প্রমাণ সাপেক্ষে অবশ্যই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে।