১২ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার

গুলিবিদ্ধ হয়েও মাকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন বাকি বিল্লাহ

এইদিন এইসময় ডেস্ক
spot_img
spot_img

‘আমার সামনেই পুলিশ-বিজিবির গুলিতে কয়েকটি তাজা প্রাণ ঝরে যায় চোখের পলকে। তখন আমিও গুলিবিদ্ধ। বাম হাত নাড়াতে পারছি না, এর মধ্যে আরেকজন গুলি খেয়ে আমার সামনেই লুটিয়ে পড়ে। ডান হাত দিয়ে কোনো রকম তাকে আগলে সামনে অগ্রসর হতেই আমার বাম পায়ের রানে পেছন দিক থেকে আরেকটি গুলি এসে লাগতেই মাটিতে পড়ে যাই। তখন আশপাশ থেকে কয়েকজন এগিয়ে এসে আমাকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে যায়। আমি ততক্ষণে অচেতন হয়ে পড়ি।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসে এমনই লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিলেন রাজধানীর প্রাইম ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের ছাত্র মো. বাকি বিল্লাহ (২৪)।

তিনি পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ডালবুগঞ্জ ইউনিয়নের নূরপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. ইমাম হোসেনের বড় ছেলে।

গত ১৮ জুলাই দেশব্যাপী যখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন পুরো চাঙা হয়ে ওঠে তখন বাকি বিল্লাহ ঢাকার রামপুরায় অবস্থান করছিলেন। সহপাঠীদের সঙ্গে তিনিও নেমে পড়েন সেই আন্দোলনে।

ছাত্র-প্রশাসন মুখোমুখি, থমথমে অবস্থা। স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল রাজধানীর অলিগলি। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ-বিজিবি এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। তবুও ছাত্ররা পিছু না হটে সামনের দিকে এগিয়ে চলে।

তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে, ঘড়ির কাঁটায় ৭টা ছুঁই ছুঁই। স্লোগানে স্লোগানে এগিয়ে যেতেই বাকি বিল্লাহর বাম হাতে একটি গুলি এসে লাগে। হাত ছিদ্র হয়ে ওপাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। তবুও মরণপণ এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এমন সময় তার সামনে আরেকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে। তাকে ডান হাত দিয়ে কাঁধে তুলে সামনে অগ্রসর হওয়ার সময় আরেকটি গুলি লাগে তার পায়ে।

বাকি বিল্লাহ বলেন, নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এরমধ্যে একটি মৃত্যু আমাকে খুবই মর্মাহত করেছে, খুব কাঁদিয়েছে। আমার সামনেই একটি পথশিশুকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ছেলেটা আমাদের মিছিলের সঙ্গেই ছিলো। ওর বাহুতে একটি গুলি লেগে ওর বাম হাতটা প্রায় ৪-৫ ফুট দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে, ছেলেটা ওখানেই মারা যায়। চোখ বুজলেই আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। এখনও গা শিউরে ওঠে, কান্না আসে।

তিনি আরও বলেন, আমাকে গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে রাজধানীর নাগরিক হাসপাতালে, পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসকরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিলেও পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে পরিচিত এক আইনজীবী অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে তার বাসায় রেখে সেবাযত্ন করেন। পরে মা গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাড়ি নিয়ে আসেন।

এরই মধ্যে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালের বেডে শুয়ে তার মায়ের সঙ্গে ফোনে কথোপকথনের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা যায়, বাকি বিল্লাহ তার মাকে আসল ঘটনা আড়াল করে অ্যাজমা সমস্যার কথা বলছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার মা হার্টের রোগী। আমি চাইনি মা-বাবা টেনশন করুক, কিংবা আমার এমন অবস্থার কথা শুনে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ুক। তাই বিষয়টা গোপন রেখেছিলাম।

বাকি বিল্লাহ বলেন, স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে যেন এভাবে আর কারও ওপর গুলি ছোঁড়া না হয়। অধিকার আদায়ের জন্য যেন আর কোনো মায়ের বুক খালি না হয়। আমি মনে করি, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা যে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি, তা হবে বৈষম্যহীন।

সর্বশেষ নিউজ