৫ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার

ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের দুই মাসে কী পরিবর্তন এলো দেশে?

ফারহানা সুমনা
spot_img
spot_img

ছাত্র—জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর ৮ আগষ্ট নোবেল বিজয়ী, আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ড. ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। ওইদিন‌ই প্রধান উপদেষ্টাসহ ১৩ জন উপদেষ্টা বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নেন। শুরুতে প্রধান উপদেষ্টাসহ এই সরকারের সদস্য সংখ্যা ছিলো ১৭ জন। এরপর আরও তিন দফায় কয়েকজন উপদেষ্টা শপথ নিয়েছেন। বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টা ২১ জন।

যে প্রত্যয় নিয়ে ছাত্র জনতা জীবন দিয়েছেন, তাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে ন্যায়বিচার ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। নতুন এই সরকারের হাতে গত দুই মাসে প্রশাসনের শীর্ষ পদে ব্যাপক রদবদলের ঘটনা ঘটেছে। যা এখনো চলমান আছে। আর্থিক খাত সহ দেশের বেশকিছু ক্ষেত্রে নেয়া হয়েছে সংস্কার উদ্যোগ। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করে তাদের জায়গায় বসানো হয়েছে প্রশাসক। ব্যাংক খাত সংস্কারের জন্য আলাদা কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অনিয়ম ও ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

সব মিলিয়ে গত ২ মাসে ঠিক কী কী ঘটনা ঘটেছে:
জনগণের জানতে চাওয়ার বা আকাঙ্ক্ষার একটা বিষয়ে পরিণত হয়েছে, দুই মাসে দেশ কী পরিবর্তন এলো। কারণ জুলাই—আগস্টের গণ বিপ্লবে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। তৎকালীন স্বৈরাচার সরকারের সুসজ্জিত বাহিনীর সামনে বুক পেতে দিয়ে মৃত্যুবরণ করার চেতনা থেকেই বিপ্লবের সফলতা এসেছে। তাই বলা যায়, বৈষম্যবিরোধী স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে, সরকারের নেয়া প্রতিটি পদক্ষেপের বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষ সচেতন দৃষ্টি রেখেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম পদক্ষেপ ছিলো চরমভাবে অবনতি হয়ে যাওয়া আইন শৃংখলা বাহিনীর পুনর্গঠন করে শৃংখলা ফিরিয়ে আনা।

পুলিশের থানায় ফেরা ও পরিবর্তন :
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থানা ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। এসময় অস্ত্র ও বেশকিছু মালামাল লুট হয়। গুলি করা ছাত্র জনতাকে হত্যা করতে গিয়ে অনেক পুলিশ সদস্য‌ও ঘটনাস্থলে আক্রান্ত হন।এমন পরিস্থিতিতে কর্মস্থলে নিরাপত্তাসহ ক্ষতিপূরণ ও আরো বেশ কিছু দাবিতে কর্মবিরতি পালন করে পুলিশ সদস্যরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা( পরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা)অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বেশ কয়েক দফা বৈঠকের পর পুলিশের দাবি পূরণের আশ্বাস দেন। এর প্রেক্ষিতে ১১ আগষ্ট কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে থানায় ফেরেন পুলিশ সদস্যরা।সংস্কারের পদক্ষেপ হিসেবে পুলিশ বাহিনীর পোশাক ও লোগো পরিবর্তন এর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল :
গত দুই মাসে প্রশাসনিক বিভিন্ন পদে ব্যাপক রদবদল হতে দেখা গেছে। স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নতুন করে বদলি পদায়ন ও নিয়োগ করা হয়েছে কয়েকশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে।
অনেকেই হয়েছেন বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি)।বেশ কয়েকজন কে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে আলোচিত অনেক আমলাকে। নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোস্তফা কামাল, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীসহ আরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। সরকারি কর্মকমিশনের পরীক্ষার সব ধাপে উত্তীর্ণ হওয়ার পরও গত দেড় যুগে নিয়োগ না পাওয়া আড়াইশো র বেশি ব্যক্তিকে সম্প্রতি নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার।

বিচার বিভাগে বড় পরিবর্তন :
আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর বিচার বিভাগের বড় ধরনের কিছু পরিবর্তন ঘটতে দেখা গেছে। ১০ আগস্ট পদত্যাগে বাধ্য করা হয় আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে। আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিরাও তার সংগে পদত্যাগ করেন। অন্যদিকে, আগের নিয়োগ বাতিল করে সম্প্রতি সারা দেশে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যটর্নি নিয়োগ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত দুই মাসে সরকারি, আধা সরকারি এমনকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগের হিড়িক দেখা যায়।

ব্যাংক খাত:
পদত্যাগ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তার আগে ডেপুটি গভর্নর সহ অন্তত চারজন শীর্ষ কর্মকর্তা পদত্যাগ করেন।ইসলামি ব্যাংসহ কয়েকটি ব্যাংক এর আগের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া প্রেসক্লাবের মতো প্রতিষ্ঠানেও শীর্ষপদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। একই ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে কর্মরত কর্মকর্তা দের বেলায়ও।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ:আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় অর্ধশত মন্ত্রী, ও সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। ইতিমধ্যে আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন আর রশিদসহ অনেক এমপি মন্ত্রীর ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে।
বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাবস্থা করা হয়েছে।

শিক্ষা প্রশাসন:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য,সহ উপাচার্য, প্রক্টরসহ শীর্ষ পদের ব্যাক্তিরা দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এর শীর্ষ ব্যক্তিরা পদত্যাগ পত্র জমা দিয়েছেন।
চলতি বছর নবম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন তুলে দিয়ে নতুন যে শিক্ষাক্রম বিগত সরকার চালু করে

ছিলো অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার এনে আবারও বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যাবসায়ে শিক্ষা শাখা চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আইন-বিচার
সাজা বাতিল করা :শ্রম আইন লঙঘনের মামলা ও দুর্নীতি দমন কমিশনের করা আত্মসাৎ মামলা থেকে সম্প্রতি খালাস পেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাষ্ট দুর্নীতির মামলা সহ মানহানীর অভিযোগে দায়ের করা পাঁচটি মামলা থেকেও খালাস পেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
এছাড়া বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার ও কারাবন্দী বিএনপি, জামায়াত ও তাদের সমমনা দলগুলোর শীর্ষ নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অসংখ্য নেতা কর্মীরা। দুর্নীতি, হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন সহ নানান অভিযোগে অভিযুক্ত দের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে এবং তাদের কে আইনের আওতার নিয়ে আসা হচ্ছে।

গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন :
স্বৈরাচার সরকারের ১৫ বছর সময়ে গুমের ঘটনা ছিল নিত্যনৈমেত্তিক ব্যাপার। গুম হয়ে যাওয়া ব্যাক্তিদের চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পাঁচ সদস্যের একটি গুম তদন্ত কমিশন গঠন করেছে সরকার।

উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ সম্পাদিত হলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ
যথাযথ ভাবে সম্পন্ন হচ্ছে না বলে অনেকেই মনে করছেন। আন্দোলনে আহত ও নিহত দের পূর্নাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন, আহতদের জন্য উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যাবস্থা করা, গণহত্যার বিচার এবং হতাহতদের
পুনর্বাসন এর কাজগুলো এখন পর্যন্ত শুরুর দিকেই রয়ে গেছে।
বর্তমান বাংলাদেশের বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত অনতিবিলম্বে জাতির সামনে তুলে ধরা উচিৎ বলে মনে করছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার। গনহত্যাকারী এবং তাদের সমর্থকদের নতুন বাংলাদেশে অবস্থান কী হবে?সে বিষয়টি নিয়ে তিনি কথা বলেন।
নতুন বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কার থেকে শুরু করে সমগ্র অবকাঠামো কে ঢেলে সাজাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে রয়েছে একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। এছাড়াও বিগত সরকারের ষড়যন্ত্রকারী এক শ্রেণির স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি রয়ে গেছে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা গুলোতে।এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সরকার ও বাংলাদেশ কে সফল করতে হলে সরকার ও জনগনকে একসাথে কাজ করতে হবে বলে বিজ্ঞজনেরা মনে করছেন।

সর্বশেষ নিউজ