২২ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবার

আমার ১৬ বছরের ছোট ছেলেকে মারতে এতো গুলির দরকার হলো পুলিশের: নাফিজের বাবা

ফারহানা সুমনা
spot_img
spot_img

জুলাই মাসে জোরদার হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। তখন থেকেই স্বৈরাচার সরকারের দমন পীড়ন আচরণের কারণে আন্দোলন শেষ না হয়ে তীব্র গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। অসংখ্য ছাত্রের আহত হওয়া, শহিদ হওয়া, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে জনপথকে রণক্ষেত্রে পরিণত করা— এসব ঘটনা ছাত্রদেরকে শেষ পর্যন্ত এক দফা দাবির জন্য দাড়াতে বাধ্য করে।

দিনটি ছিলো ৪ আগস্ট। সকাল ১১ টা। আন্দোলনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল রাজধানীর বনানী বিদ্যানিকেতন থেকে সদ্য এস‌এসসি পাশ করা গোলাম নাফিজ। দেশের জন্য অন্তপ্রাণ নাফিজ প্রথমে শাহবাগ মোড় পর্যন্ত যায়। ষপরে শাহবাগ মোড় থেকে ফিরে ফার্মগেট যায়।

সেদিন আন্দোলনের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হবার সময় সকালে নাফিজ তার বাবার কাছে বিশ টাকা চেয়েছিল। বাবা বলেছিলেন, একশ টাকা নাও। নাফিজ বলেছিল না। ত্রিশ টাকাই দাও।
সেই ত্রিশ টাকা দিয়ে বাংলাদেশের একটা পতাকা
কিনে মাথায় বেঁধে অন্য আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সড়কে যুক্ত হয়।

ওইদিন দুপুর ৩ টার দিকে মায়ের সাথে শেষ কথা হয় নাফিজের। মা নাফিজকে বাড়ি ফিরে আসতে অনুরোধ করেন। নাফিজ বলে, মা আমি ঠিক‌ই চলে আসব। কিন্তু এরপর ছেলের ফোন বন্ধ হয়ে যায়। সংযোগ পাননি ছেলের। নাফিজের বাবা গোলাম রহমান ছেলের সন্ধান শুরু করেন।

কিন্তু এর‌ই মধ্যে নাফিজের জীবনে ঘটে গেছে রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীর নারকীয় গুলির ঘটনা। কাছ থেকে গুলির আঘাতে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে সে। গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তার শরীর। গুলিতে নাফিজের সবগুলো দাঁত খুলে পড়ে। রাস্তায় লুটিয়ে পড়া নাফিজকে কেউ তুলে নিয়ে হাসপাতালে যেতে সাহস করেনি। একদিকে পুলিশের গুলি চলছে চারদিকে, নাফিজকে নিতেও বাঁধা দিচ্ছে, অপরদিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হাফিজের রক্তাক্ত দেহ হাসপাতালে নিতে দিচ্ছে না কাউকে। এমন এক দৃশ্যপট তৈরি হয় তখন।

হঠাৎ একজন মানবিক রিকসা চালক সাহস করে গুলি ও বাঁধার মুখে হাফিজের গুলিবিদ্ধ দেহ টেনে তার রিকসার পাদানীতে তুলেন। তোলার পর নাফিজের দেহ আড়াআড়িভাবে ঝুলে থাকে।
ঝুলে থাকে নিস্তেজ হাত পা,মলিন মুখ। করুন এই দৃশ্যটি কাঁদিয়েছে দেশের কোটি কোটি মানুষকে। কাঁদিয়েছে বিশ্ববাসীকে।

এবার সেই মানবিক সাহসী রিকসা চালকের সন্ধান করে খুঁজে পাওয়া যায়। তার নাম নূর মোহাম্মদ ।
কথা হয় তার সাথে। তিনি জানান, ওইদিন ফার্মগেট পুলিশ বক্স পাড়ি দিয়ে যাওয়ার সময় প্রচন্ড গোলাগুলির শুরু হয়। পুলিশ আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে‌। রিকসায় অজ্ঞান নাফিজকে তুলে গেলে বাঁধা দেয়। অথচ তখন ছেলেটাকে রিকসায় বসিয়ে নেয়ার উপায়ছিলো না। পরে পাদানিতে শুইয়ে দেয়া হয় তাকে। নাফিজের হাত ঝুলে ছিল রিকসার চেনের সাথে । তাই হাতটাকে রিকসার রডের সাথে বেধে নেই। এসময় কিছু পুলিশ নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলো,ছেলেটাকে আরো দুই টা গুলি করো। রিকসা চালককে একটা গুলি করো।
এভাবে রাস্তায় রাস্তায় গুলাগুলির মুখে তাকে নিয়ে র‌ওয়ানা দেই।

নাফিজকে নিয়ে গেলাম ফার্মগেট আল রাজি হাসপাতালে। কেউ বললো, ঢাকা মেডিকেল অথবা সোরোওয়ার্দি হাসপাতালে নিয়ে যেতে। অথচ কেউ এসে একটুও সাহায্য করল না। আমি অবশেষে একটি অটো করে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে তাকে পাঠাই। যারা নাফিজকে নিয়ে যেতে রাজি হলো, তাদের বললাম,বাঁচলে ছেলেটার চিকিৎসা করা যাবে। আর না হলে সরকারি হাসপাতালে থাকলে ওর বাবা মা কোন না কোনোভাবে খুঁজে নেবে।

নুর মোহাম্মদ বলেন, নাফিজকে যখন অটোতে তোলা হচ্ছিল তখন প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে গেছে।
রক্ত ভরে গিয়েছিলো। আমার রিকসায় এখনো শহীদ নাহিদের রক্তের দাগ। তা শুকিয়ে কালো বর্ণ ধারণ করেছে।

নাফিজের বাবা একজন বীর যোদ্ধা। ছেলের বিষয়ে তিনি বলেন, সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, যেভাবে ওর শরীরে আঘাত করেছে,গুলি করেছে— নাকে,মুখে,মাথায়,পায়ে পুরো শরীর ঝাঁঝরা করে দেয় পুলিশ। আঘাতের পর আঘাত, আঘাতের পর আঘাত। এত আঘাত এতো গুলি কী খুব দরকার ছিল? ১৬ বছরের একটা ছেলেকে একটা লাঠি দিয়ে সামান্য আঘাত করলেই তো সরে যেত। তার বুকে‌ গুলি করেছে। গুলিটা শরীর ছেদ করে বেড়িয়ে গেছে।
চিকিৎসক বলেছেন, খুব কাছ থেকে গুলিটা করা হয়েছে। নাফিজের রিক্সায় পাদানিতে শুয়ে থাকার ছবিটি দেখে চিনতে পারেন তিনি। তখনই তার ধারণা হয়, ছেলে হয়তো আর বেঁচে নেই।

ওইদিন রাত সাড়ে তিনটার দিকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে গিয়ে দেখি আমার ছেলের লাশ পড়ে আছে। মাথার মধ্যে লাল সবুজের পতাকা বাঁধা।

পতাকার জন্য স্বাধীনতার প্রয়োজন। স্বাধীনতা বিহীন কোন পতাকা হয়না। তাই তো বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা রক্ষা করার জন্য ১৬ বছর বয়সের নাফিজও বুক পেতে দেয়। ঢেলে দয় বুকের তাজা রক্ত।আর এই রক্তের বিনিময়ে পাওয়া পতাকাটি মাথায় জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে ছেলে। এতো রক্তের বিনিময়ে জানি না বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে কিনা— বলছিলেন নাফিজের বাবা।

সর্বশেষ নিউজ