১০ ডিসেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার

অর্ধেক মানুষ জানেনই না তিনি ডায়াবেটিসের মধ্যে আছেন কিনা

নিজস্ব প্রতিবেদক
spot_img
spot_img

বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস আজ। ডায়াবেটিস সম্পর্কে বিশ্ববাসীর সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিবছর ১৪ নভেম্বর দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে।

বিশ্ব ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯১ সালে ১৪ নভেম্বরকে ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

দিবসটিতে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে ‘ডায়াবেটিস: সুস্বাস্থ্যই হোক আমাদের অঙ্গীকার’।

ডায়াবেটিস আজীবন বহন করে চলা একটি অসুখ।এ অসুখটিকে নিয়ন্ত্রণ করে চলাই একমাত্র সমাধান।ডায়াবেটিস কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেই বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

আপনি কী জানেন ডায়াবেটিস কি? চলুন প্রথমে তা জেনে নেওয়া যাক-

ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের দেয়া সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ডায়াবেটিস এমন এক দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা যার ফলে শরীরে কার্যকরভাবে ইনসুলিন হরমোন তৈরি বন্ধ হয়ে যায়।

যদি সহজ ভাষায় বলি, ডায়াবেটিস এমন একটি শারীরিক অবস্থা যার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে শর্করার মাত্রা অনেক বেশি বেড়ে যায়। এতে একবার কেউ আক্রান্ত হলে সারা জীবনের জন্য তা বয়ে বেড়াতে হয়।

তবে, খাদ্যাভাসে পরিবর্তন ও নিয়মিত শরীরচর্চা করলে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে এ ধরনের ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।

আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১ কোটি ৩১ লাখ ৩৬ হাজার ৩০০ জন।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির তথ্য মতে, প্রতি ২ জনে ১ জন জানেন না তাদের ডায়াবেটিস আছে। কারণ, অসুস্থ না হলে কেউ চিকিৎসকের কাছে যান না। একই সঙ্গে যারা আক্রান্ত তাদের অর্ধেকই নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। যার ফলে ইনসুলিনের উপর নির্ভর করে চলতে হচ্ছে তাদের।

১৯৯১ সাল থেকে ১৪ নভেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। ১৯৯১ সালে বিশ্ব ডায়াবেটিস ফেডারেশন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই দিনটিকে ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়।

আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আই.ডি.এফ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে সারা বিশ্বে মোট ডায়াবেটিস রোগী সংখ্যা ছিল ৫৪ কোটি। এর মধ্যে ২৭ কোটি মানুষ জানতো তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এসব আক্রান্তের মধ্যে প্রতি ৪ জনে ৩ জনের বেশি নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে বাস করেন। ধারণা করা হচ্ছে,  এ সংখ্যা ২০৪৫ সালে আক্রান্তের সংখ্যা ৭৮ কোটিতে পৌঁছাবে।

আইডিএফ’র তথ্য অনুযায়ী ডায়াবেটিস রোগীর পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে অষ্টম।

২০৪৫ সালে এ সংখ্যা দুই কোটি ছাড়াবে। যা বাংলাদেশকে আক্রান্তের দিক থেকে সপ্তম স্থানে নিয়ে আসবে।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির তথ্য মতে, প্রতি পাঁচ জনে একজন ডায়বেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) দেওয়া তথ্য মতে, বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত লাখ লাখ মানুষের ডায়াবেটিসে যত্নের অ্যাক্সেস নেই।

এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ম মাফিক যত্ন নেওয়া এবং জটিলতা এড়াতে সহায়তা প্রয়োজন। ওষুধ, প্রযুক্তি, সহায়তা এবং যত্ন— তাদের জন্য আবশ্যিক।

ডায়াবেটিসের যত্ন এবং প্রতিরোধে সরকারের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন।

ডায়াবেটিক সমিতির দেওয়া তথ্য মতে,  ৬৩ লাখ ডায়াবেটিস রোগীকে এখন পর্যন্ত সেবার আওতায় আনা গেছে। এখনও ৬৮ লাখ রোগী সেবার বাইরে রয়েছে।

সমিতির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে  বলেন, ডায়াবেটিস আক্রান্ত এমন ৫০ শতাংশ শনাক্ত হলেও এর ২৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন, বাকিরা পারছেন না। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে ও নিয়ন্ত্রণ গণসচেতনতা ও সমন্বিত পরিকল্পনা করতে হবে। এভাবেই চলতে থাকলে ডায়াবেটিস রোগী বহুগুণে বেড়ে যাবে। এই রোগ তো আজীবনের রোগ এবং ব্যয়বহুল বিষয়।

তিনি বলেন, ডায়াবেটিস রোগী বিশ্বব্যাপী বাড়ছে। কিন্তু কতো হারে বাড়ছে সেটা বলা মুশকিল। তবে অনেক বেশি বাড়ছে। মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতির পরিবর্তনের কারণে ডায়াবেটিস রোগী বাড়ছে। এই যে অপরিকল্পিত নগরায়ন, বিভিন্ন ধরনের ফাস্টফুড, কায়িক পরিশ্রম না করার কারণে মুটিয়ে যাওয়া হচ্ছে ডায়াবেটিস রোগী বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ। এভাবেই চলতে থাকলে ডায়াবেটিস রোগী বহুগুণে বেড়ে যাবে। এই রোগ তো আজীবনের রোগ এবং ব্যয়বহুল বিষয়।

অধ্যাপক এ কে আজাদ খান বলেন, শুধু বাংলাদেশ না, পৃথিবীর সব জায়গায় এর চিকিৎসা ব্যয়বহুল। কিছু কিছু রোগীর ইনসুলিনের প্রয়োজন হয়। কারণ, এই রোগের মূল কারণই ইনসুলিন কমে যাওয়া। ইনসুলিন মানুষের জীবনের অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস। কারও কারও ইনসুলিনের মাত্রা এতই কমে যায়, যার ফলে তাকে আজীবন ইনসুলিন নিতেই হবে। আজীবন ইনসুলিন গ্রহণ করা খরচের ব্যাপার তো বটেই।

শনাক্তের বাইরে থাকা রোগীদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। একজন মানুষের লক্ষণ থাকুক কিংবা না থাকুক, একটি বয়স পার হলে নিয়মিত পরীক্ষা করবেন ডায়াবেটিস আছে কিনা।

সাধারণত ৪০ বছর পর চেক করার পরামর্শ আমরা দেই। কিন্তু তার আগেই যদি কেউ বেশি মুটিয়ে যায় কিংবা পরিবারের কারও ডায়াবেটিস থাকে তাহলে আরও আগে থেকে পরীক্ষা করা শুরু করতে হবে।

তিনি বলেন, সাধারণত কায়িক পরিশ্রম না করলে, মাত্রাতিরিক্ত ফাস্টফুড খেলে, অতিরিক্ত কোমল পানীয় পান করলে বা মোটা হয়ে গেলে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এসব বিষয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করা, উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি। আর এ তিনটি কাজ করতে হলে প্রয়োজন দৈনন্দিন জীবনযাপনে শৃঙ্খলা।

এবার বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসকে সামনে রেখে ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের ৫টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এগুলো হলো- ৮০ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগীকে রোগ নির্ণয়ের আওতায় আনা।

৮০ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগীর রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা।

৮০ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগী রক্তচাপ সুনিয়ন্ত্রণে রাখা, ৬০ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগী, যাদের বয়স ৪০-এর বেশি তাদের স্ট্যাটিন জাতীয় ওষুধ পাওয়া নিশ্চিত করা। শতভাগ টাইপ-১ ডায়াবেটিক রোগীর কাছে ইনসুলিন ও অন্যান্য সুবিধা পৌঁছে দেওয়া।

ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রোড শো, বিনামূল্যে বিনামূল্যে ডায়াবেটিস নির্ণয়, আলোচনা সভা, হ্রাসকৃত মূল্যে হার্ট ক্যাম্প, স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি।

এসব অনুষ্ঠান ছাড়াও ডায়াবেটিস সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে দৈনিক পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ, ‘কান্তি’ ও ‘ডায়াবেটিস নিউজলেটার’-এর বিশেষ সংখ্যা, সচেতনতামূলক পোস্টার ও লিফলেট প্রকাশেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে একটি কমন অসুখ হলো ডায়াবেটিস। অথচ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অর্ধেকের বেশি মানুষ জানেনই না যে তারা এই রোগে আক্রান্ত। ডায়াবেটিস রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকার  করার জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা। আর সে সচেতনতা বৃদ্ধিতেই এ দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে

সর্বশেষ নিউজ