যুক্তরাষ্ট্রের ৬০তম জাতীয় ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাপুটে জয়ের মধ্যে দিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্জন্ম হয়েছে। ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের রানিংমেট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট এবং পপুলার ভোট দুই ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য ব্যবধানে হারিয়ে আট বছর পর রেকর্ড সৃষ্টি করে জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন ৭৮ বছর বয়সী এই রিপাবলিকান প্রার্থী। ১৩১ বছর পর মার্কিন রাজনীতির ইতিহাসে পরাজিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফের জয়লাভ করেন তিনি। সিনেট এবং প্রতিনিধি পরিষদে বড় বিজয়ের পাশাপাশি কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে ট্রাম্প নেতৃত্বাধীন রিপাবলিকান পার্টি। দ্বিতীয়বারের মতো মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, রিপাবলিকান পার্টির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে। ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটকে হটিয়ে ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প নির্বাচিত হয়েছেন। এখন শুধু শপথ নেয়ার আনুষ্ঠানিকতা বাকি।
নির্বাচনকালীন তার জনসংযোগ ও রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যে একটি প্রধান বৈশিষ্ট ছিল আমেরিকার সমাজের প্রতিটি শ্রেণির কাছে জোরালো বার্তা পৌঁছানো। অভিজাত বা সংখ্যালঘু সব স্তরের মানুষের উদ্বেগকে প্রভাবিত করতে জনমুখী ভাষা ব্যবহার করা হয়।
সাম্প্রতিক নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক উদ্বেগকে ছাপিয়ে ট্রাম্পের জনমুখী পররাষ্ট্রনীতি তার জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যে (সুইং স্টেট)। এই বিশাল জয় অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
ট্রাম্প আদতে বিশ্বব্যাপী কী ধরনের পররাষ্ট্রনীতি প্রয়োগ করতে পারেন। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি এই নতুন ট্রাম্প যুগে কীভাবে বিবর্তিত ও পরিবর্তিত হবে, এবং এই পরিবর্তন কী বিশ্বব্যাপী সংকটগুলোকে প্রভাবিত করবে?।
বিশ্বকে নতুন অস্থিরতায় নিয়ে যাওয়া: ২০১৩ সাল থেকে আমেরিকার নেতৃত্ব এবং পররাষ্ট্রনীতি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে, বিশেষ করে বৈশ্বিক রাজনীতিতে চীনের বাড়তি প্রভাবের কারণে। বেইজিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এদের অন্যতম। এই প্রেক্ষাপটে, সাম্প্রতিক সঙ্কটগুলো যেমন ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের নির্বিচারে হামলা ও আগ্রাসন এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে এসব জটিল সমস্যার মোকাবিলা করবে তা নিয়ে বড় অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।
ট্রাম্পের দ্বিতীয়বারের বিজয় এই প্রশ্নগুলোকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে, কারণ সমালোচকরা ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের তার প্রথম মেয়াদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। এটি স্পষ্ট যে, বিশ্ব একটি নতুন অস্থিরতার পর্যায়ে প্রবেশ করছে, যেখানে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তনের শঙ্কা রয়েছে। ফলাফল ইতিবাচক হবে না কি নেতিবাচক তা এখনো বলা সম্ভব নয়, তবে স্বল্পমেয়াদে আমরা বৈশ্বিক রাজনীতিতে বাড়তি বিশৃঙ্খলা এবং অস্থিরতার শঙ্কা করতে পারি। সংবাদমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সিতে প্রকাশিত তুরস্কের আঙ্কারায় ইয়িলডিরিম বেয়াজিত বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কৌশলগত গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক নাজমুল ইসলামের নিবন্ধে এসব উঠে এসেছে।
ট্রাম্পের পররাষ্ট্র নীতি: এটি সম্ভবত বলা যাচ্ছে, ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ফের কর্তৃত্ববাদী এবং কট্টর পররাষ্ট্র নীতি প্রয়োগ করতে যাচ্ছে। যদিও রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ করা এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প, তবে এ সফলতা অর্জন আগের চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।
ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলায় ৪৩ হাজারের বেশি নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ট্রাম্প কি এই আগ্রাসন বন্ধ করবেন? সহজে বলা যায় ‘না’। এর পরিবর্তে তিনি সম্ভবত ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ বা আব্রাহাম চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করবেন। সেই সঙ্গে ইসরায়েলের পার্শ্ববর্তী মুসলিমপ্রধান দেশের সমর্থন আদায়ে মনোনিবেশ করবেন। বল প্রয়োগ বা প্ররোচনা দিয়ে এসব দেশের কাছ থেকে ইসরায়েলি অভিযানের প্রতি সমর্থন আদায় করে নেবে। সেই সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের ওপর তেল আবিবের দমন-পীড়নকে এড়িয়ে যেতে এসব দেশের সম্মতি আদায় করে নেবে ওয়াশিংটন।
এটি উল্লেখ না করলেই নয়, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ট্রাম্পই প্রথম নেতা যিনি জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তার নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, বাইডেন প্রশাসনের চেয়ে ইসরায়েলকে বেশি সমর্থন করবেন। এছাড়া, নেতানিয়াহুর সরকার বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের চেয়ে ট্রাম্পের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল ছিল।
ট্রাম্পের বক্তব্যে ইসরায়েলি বাহিনীর ফিলিস্তিনের ওপর আগ্রাসনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি প্রায়ই ‘শান্তি’ শব্দটি ব্যবহার করেন, তবে ইসরায়েলের বর্বরোচিত একতরফা আগ্রাসন বন্ধের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সুস্পষ্ট মন্তব্য এড়িয়ে যান। এটি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রসঙ্গে তার কৌশলগত অবস্থান থেকে অনেকটা ভিন্ন। এটি ইঙ্গিত দেয়, ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে ফিলিস্তিনের জাতীয় স্বার্থ বা ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা কম।
ইরানকে নিয়ে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদেও তেহরানের পারমাণবিক চুক্তির বিষয়ে কোনো কূটনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে হলে ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যে তার বর্তমান পররাষ্ট্র নীতিতে সমঝোতা করতে হতে পারে। তা না হলে, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিশানায় পড়ে যাবে তেহরান।যদিও ইরান-ইসরায়েল বা ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা কম, তবে ছোট-পরিসরে সংঘাত নিয়মিত হয়ে উঠতে পারে এবং এটি অঞ্চলের অস্থিরতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে ধারণা করা হচ্ছে, ইউক্রেনের অগ্রগতি থামানোর পাশাপাশি রাশিয়ার জন্য সহায়ক মোড় তৈরি করার চেষ্টা করবেন ট্রাম্প। এটা স্পষ্ট যে, ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত সামরিক বা অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়ার পরিকল্পনা মাথায় রাখছে না। এতে করে ইউরোপ বা যুক্তরাজ্যকে যুদ্ধের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, অথবা ইউক্রেনকে দেশটির জাতীয় স্বার্থে একটি সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। শেষমেষ বলা চলে, ট্রাম্পের পদক্ষেপগুলো রাশিয়া এবং পুতিনের জন্য লাভজনক হবে।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ থেকে শুরু করে দ্বিতীয় মেয়াদেও এটি স্পষ্ট যে, তিনি রাশিয়ার সঙ্গে আরও সমস্যায় জড়াতে চান না; বরং, তিনি চীনের আধিপত্য এবং প্রবণতাকে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, এবং ইউরোপে সীমিত করতে চান। এই মেয়াদে, এই কৌশলে সম্ভবত কোনো ব্যতিক্রম হবে না।
আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির শঙ্কা করতে পারি। এসব ক্ষেতগুলো মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য, প্রযুক্তি, মহাকাশ, শক্তি, ডিজিটালাইজেশন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
চীনের জন্য ট্রাম্পের সময়কাল বিশেষভাবে চ্যালেঞ্জিং হবে এবং এর ফলে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আরও ছায়াযুদ্ধ দেখতে পাবো, যা যুক্তরাষ্ট্র-চীনের প্রতিযোগিতার ফলস্বরূপ হতে পারে।
পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ, যেমন তাইওয়ান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান, মিয়ানমার এবং ফিলিপাইন বিশ্বের এই দুই শক্তির (যুক্তরাষ্ট্র-চীন) পররাষ্ট্র নীতি এবং জাতীয় স্বার্থের কারণে সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে।
এর বাইরে আইএমএমইসি, আইপিএস, এইইউকেইউএস এবং কিইউএডি এর মতো নিরাপত্তা জোট এবং সংগঠনগুলো নিয়ে ট্রাম্পের এজেন্ডায় থাকবে চীনের উত্থান রুখে দেয়া।
ইউরোপের জন্য ট্রাম্প প্রশাসন সম্ভবত আরেকটি অন্ধকার যুগ হিসেবে বিবেচিত হতে যাচ্ছে, যা ওয়েস্টফালিয়া শান্তি চুক্তি বা ফরাসি বিপ্লবের আগেকার সময়কালকে মনে করিয়ে দেয়।
ইউরোপের নিরাপত্তা এবং ন্যাটোর ভবিষ্যত আবারও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠবে। ইউরোপীয় দেশগুলোকে তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনা এবং সম্ভবত জোরালো করতে হবে। এছাড়া, পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের সহানুভূতির সম্পর্ক ইউরোপের ভবিষ্যত নিরাপত্তার জন্য ক্রমাগত হুমকি তৈরি করবে।
ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের পর ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আমরা এক নতুন ধরনের বিশ্ব রাজনীতি প্রত্যাশা করতে পারি যা প্ল্যাটফর্ম এক্স-এর মাধ্যমে পরিচালিত হবে, যা একের পর এক আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্ম দিতে পারে। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এবং ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ এর মতো স্লোগানগুলো আবারও প্রতিধ্বনিত হবে, বিশেষত শেতাঙ্গ প্রাধান্য ও ইসলামভীতি ইউরোপীয় উগ্র ডানপন্থীদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে দেবে। উদারপন্থী আন্তর্জাতিক ক্রিয়ানকের পতন ঘটতে পারে।