২ ডিসেম্বর ২০২৪, সোমবার

এইচএসসি পাসের পরই বিসিএস পরীক্ষার সুপারিশ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের

নিজস্ব প্রতিবেদক
spot_img
spot_img

অন্তর্বর্তী সরকার জনপ্রশাসন সংস্কারে গত ৪ অক্টোবর সাবেক সচিব আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের কাছে দেওয়া সুপারিশ সামনে রেখে শনিবার রাজধানীতে একটি সেমিনার আয়োজন করে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।

‘প্রশাসনিক সংস্কার ও উন্নয়ন: বর্তমান প্রেক্ষিত ও ভবিষ্যৎ ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া।

এতে প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবসহ প্রশাসন ক্যাডারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা কথা বলেন। তাঁদের অধিকাংশই মূলত বিগত সরকারের আমলে পদ-পদোন্নতি ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তা।

তারা বলেন, ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে জনপ্রশাসন আর জনপ্রশাসন ছিল না। সেটি পরিণত হয়েছিল লুটেরাদের সহযোগীতে। এই স্বীকারোক্তি জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদেরই। তাঁরা বলেন এখন প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।

জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা যাতে রাজনৈতিক কর্মীদের মতো আচরণ করতে না পারেন, সেটা আচরণবিধির বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।

এদিকে ওই সেমিনারে এইচএসসি পরীক্ষা পাস করার পরই বিসিএস পরীক্ষা নেওয়াসহ বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়।

আওয়ামী লীগ সরকার টানা চার মেয়াদে তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন করেছে। জনপ্রশাসনকে হাতে রাখতে দলীয়করণ, গাড়ি-বাড়ি কিনতে ঋণসুবিধা, ইচ্ছেমতো পদোন্নতি দেওয়াসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় জনপ্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ নানা কর্মকাণ্ডে বিতর্কিত হয়েছিলেন। সংগঠনটিও কিছু কিছু বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিতর্ক তৈরি করেছিলবিগত সরকারের আমলে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর চুক্তিতে থাকা বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার চুক্তি বাতিল করে সরকার।অন্যদিকে হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এখন কারাগারে।

তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, সাবেক নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সাবেক সচিব মো. জাহাংগীর আলম ও মোস্তফা কামাল, সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব আমিনুল ইসলাম খান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব শাহ কামাল এবং সাবেক যুব ও ক্রীড়াসচিব মেজবাহ উদ্দীন আহমেদ।

সাবেক সচিবদের প্রায় সবার নামে হত্যা মামলা হয়েছে। অবশ্য ঢালাওভাবে বিভিন্ন হত্যা মামলায় আসামি করা নিয়ে প্রশ্নও আছে।

সাড়ে ১৫ বছরে প্রশাসনসহ সিভিল সার্ভিসকে কোন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেই প্রশ্ন তুলে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া বলেন, এটাকে কি কোনো সার্ভিস বলা যেত?

সাড়ে ১৫ বছরে যা হয়েছিল, সেটি ছিল একটা দলীয়করণ করা, লুটেরাদের সহযোগী, দেশের সমাজ-অর্থনীতি দুর্বৃত্তায়নে সহযোগীদের একটি সার্ভিস। তিনি বলেন, এটা জনপ্রশাসন ছিল না। এ রকম একটি সার্ভিস সাড়ে ১৫ বছর রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের সঙ্গে মিলে দেশকে লুণ্ঠন করে।

জনপ্রশাসন বড় ভাবমূর্তি সংকটে আছে উল্লেখ করে মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া কর্মকর্তাদের উদ্দেশে আরও বলেন, সাড়ে ১৫ বছরে যে গর্তে পড়েছিলেন, তা থেকে কীভাবে এই সার্ভিসকে ওপরে তুলে আনা হবে এবং ভাবমূর্তিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হবে, সেই পরিকল্পনা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের থাকতে হবে।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের অধীন পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ কর্তৃপক্ষের (পিপিপি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সচিব) মো. হাফিজুর রহমান।

তিনি বলেন, পদায়ন ও পদোন্নতিতে মেধা, যোগ্যতা, সাহস ও দেশ গঠনে প্রত্যয়—এগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে তদবির ও রাজনৈতিক লেজুড়ভিত্তিক গুরুত্ব দিলে ‘রাইট পারসন ইন দ্য রাইট প্লেস’ (যোগ্য জায়গায় যোগ্য ব্যক্তি) নিশ্চিত করা যায় না।

কর্মকর্তাদের সৎ সাহস ও যোগ্যতা অর্জনের উৎসাহও হারিয়ে যায়। ভয়ংকর দিক হলো, এমন হলে অযোগ্যদের শাস্তির আওতায় আনার সম্ভাবনাও কমে যায়।

অতিরিক্ত সচিব মো. শেখাবুর রহমান বলেন, প্রশাসন যন্ত্র সবচেয়ে খারাপ হওয়ার মূলে একটি কারণ হলো রাজনৈতিক প্রভাব। এই রাজনৈতিক প্রভাব থেকে যদি মুক্ত হওয়া যায়, তাহলে প্রশাসনে কর্মরত যাঁরা দক্ষ, যোগ্য কর্মকর্তা আছেন, তাঁরা অবশ্যই জনবান্ধব হিসেবে কাজ করতে পারবেন।

যুগ্ম সচিব সাখাওয়াত হোসেন বলেন, প্রভাবমুক্তভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। একেবারে সচিব থেকে শুরু করে নিচের পর্যায় পর্যন্ত প্রত্যেককে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। প্রভাবমুক্তভাবে কাজ করতে পারলে আমলাতন্ত্র অনেকাংশেই স্বচ্ছতার সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে।

এসময় সেমিনারে কর্মকর্তারা নানা সুপারিশ তুলে ধরেন। জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ আবদুল মোমেন এইচএসসি পাস করার পরেই বিসিএস পরীক্ষার পক্ষে মতামত তুলে ধরেন।

দক্ষ জনপ্রশাসনের জন্য প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোখলেস উর রহমান। তিনি বলেন, প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে সাহসী কর্মকর্তার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

১৯৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা ও অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এ বি এম আব্দুস সাত্তার বলেন, অবিলম্বে প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে।

সাবেক যুগ্ম সচিব হারুনুজ্জামান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পদে উপসচিব এবং জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পদায়নের পক্ষে মত দেন।

বর্তমানে ইউএনও পদে জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব এবং ডিসি পদে উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পদায়ন দেওয়া হয়।

মূল প্রবন্ধেও নানা সুপারিশ উঠে আসে। এর মধ্যে রয়েছে বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন (এসিআর) প্রক্রিয়ায় সংস্কারনিয়োগপ্রক্রিয়ার শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, যুগ্ম সচিব পর্যায় থেকে পরবর্তী বিভিন্ন স্তরে পদোন্নতির জন্য বিশেষ কোনো নৈর্ব্যক্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করা ইত্যাদি।

বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব মো. আনোয়ার উল্ল্যাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান।

(এএ/ ফারহানা সুমনা

সর্বশেষ নিউজ