১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, বুধবার

রাষ্ট্র মেরামতে চার সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা

ফারহানা সুমনা
spot_img
spot_img

চারটি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন আজ বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। এই চার সংস্কার কমিশন হলো সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন।

বুধবার সংস্কার কমিশনের প্রধান ও অন্য সদস্যরা রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা বলছে। এর অংশ হিসেবে দুই ধাপে মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়।

১১ টি সংস্কার এর মধ্যে গত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে গঠন করা হয় নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও সংবিধান সংস্কার কমিশন।

এর মধ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় বাড়ানো হয়েছে। বাকি চারটি কমিশনের প্রতিবেদন আজ জমা দেওয়া হলো।

সরকারের পক্ষ থেকে আগেই বলা হয়েছে, সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রস্তাবগুলো নিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করবে।

আলোচনার মধ্য দিয়ে যেসব প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য তৈরি হবে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। প্রস্তাবগুলো কবে, কোন প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন করা হবে, তার একটি রূপরেখা আসতে পারে দলগুলোর সঙ্গে সরকারের আলোচনার মাধ্যমে।

জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশার সঙ্গে মিল রেখে এক গুচ্ছ সুপারিশ করা হয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশন থেকে।  যার মূল লক্ষ্য রাষ্ট্র ও সরকারে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিকেন্দ্রীকরণ।

কমিশনের প্রধান যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, এক ব্যক্তির দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রিত্ব নয়, ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, সাংবিধানিক সংস্থা বাড়ানো ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বাড়ানোসহ সুনির্দিষ্ট কিছু সুপারিশ থাকছে কমিশনের প্রতিবদনে।

তিনি বলেন, “এককেন্দ্রীকরণ থেকে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরির প্রস্তাব থাকছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা থাকবে সুপারিশে। মূল কথা হচ্ছে আমরা এককেন্দ্রিকতা থেকে বেরোতে চাই জবাবদিহিমূলক একটা ব্যবস্থা তৈরি করতে।”

তিনি আরও উল্লেখ করেন স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, নারী আসন বাড়ানো ও তাদের সরাসরি নির্বাচনসহ নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন সভা নিয়ে একগুচ্ছ সুপারিশ থাকবে প্রতিবেদনে।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন থেকে যে সুপারিশগুলো করা হয়েছে সেগুলো হলো, নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে নির্বাচনি আইন পরিবর্তনের পাশাপাশি কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধনেরও সুপারিশ করতে যাচ্ছে কমিশন।

অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে একটি কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে একগুচ্ছ সুপারিশ রাখবে বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন।

নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ইসির নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে আইনে সংশোধন, ইসির ক্ষমতা বাড়ানো ও জবাবদিহিতা তৈরি, নির্বাচনি শাস্তি ও ব্যবস্থা নেওয়ার বিধানগুলো কিছু ক্ষেত্রে আরও সুনির্দিষ্ট করা, হলফনামার ছকে পরিবর্তন, হলফনামার তথ্য যাচাই বাধ্যতামূলক করার কথা থাকতে পারে সুপারিশে।

পাশাপাশি নির্বাচনে ‘না’ ভোটের সুযোগ যুক্ত করা, সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা করা, রাজনৈতিক দলের প্রার্থী মনোনয়ন পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন আনা, ন্যূনতম ভোটার ছাড়া নির্বাচন বাতিল, জাতীয় পরিচয়পত্রের সেবা ইসির অধীনে রাখা, দুই কক্ষের পার্লামেন্ট ও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রণয়নসহ বেশ কিছু সুপারিশ থাকছে।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম বলেন, আইনের পাশাপাশি নির্বাচন আচরণবিধিতেও স্পষ্ট পরিবর্তন এনে কঠোর তদারকির সুপারিশ করার সম্ভাবনা রয়েছে প্রতিবেদনে। এতে অধ্যায় থাকবে অন্তত এক ডজন।

আব্দুল আলীম আরও বলেন“আদালতের রায়ে গণভোট ও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফেরার পথ তো খুলছে। বিদ্যমান নির্বাচন পদ্ধতির পাশাপাশি সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি সুপারিশের কথাও ভাবছি আমরা। দুই কক্ষের পার্লামেন্টের কথাও বিবেচনায় রয়েছে।”

পুলিশ সংস্কার কমিশন থেকে সুপারিশগুলো নির্ধারণ করার জন্য সাবেক সচিব সফর রাজ হোসেনের নেতৃত্বাধীন এ কমিশন পুলিশ সংস্কারের জন্য সাধারণ মানুষের মত নিয়েছেন।সেই সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৮৮.৭ শতাংশ মানুষ এ বাহিনীকে ‘রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত’ করার ওপর জোর দেন।

বাহিনীতে নিয়োগ, বদলি, বেতনভাতা ও পদোন্নতি, বৈষম্য নিরসনসহ নানা বিষয়ে সুপারিশ থাকতে পারে।বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, সব জায়গায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ রয়েছে। সেটা ঠিক করতে না পারলে কোনোভাবেই পুলিশ সংস্কার সম্ভব হবে না।

রাজনৈতিক আমলাতন্ত্রের কারণে পুলিশ নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়।রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির বাইরে গিয়ে পুলিশকে স্বতন্ত্র কমিশনের অধীনে রাখার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সুপারিশে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জুলাই-অগাস্টে হতাহতের জন্য দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তির সুপারিশ এবং পুলিশ যেন রাজনৈতিক দলের বাহিনীতে পরিণত না হয় ও বল প্রয়োগ-সংক্রান্ত বিষয়েও সুপারিশ থাকতে পারে।

দুর্নীতি দমন কমিশন,দুদককে স্বাধীন ও কার্যকর করতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সে বিষয়ে ৪৭ দফা সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিচ্ছে এ সংস্কার কমিশন।

এ কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মোটা দাগে দুই ধরনের সংস্কারের সুপারিশ রেখে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।“একটিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের সরাসরি সংস্কার; আরেকটিতে রয়েছে এই সংস্কার কার্যকর করার জন্য পুরো রাষ্ট্রকাঠামোয় পরিবর্তন আনার সুপারিশ।”

সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়ে এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে অন্তর্বর্তী সরকার। সেই আলোচনার মাধ্যমে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেসব সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হবে। ফেব্রুয়ারিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এই আলোচনা হবে বলে আজ এক সংবাদ ব্রিফিংয়ের সরকারের দুজন উপদেষ্টা জানিয়েছেন।

সর্বশেষ নিউজ