অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হবে একটি গণঅভ্যুত্থানের সনদের ভিত্তিতে।
তিনি জানান, সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সনদ তৈরি করা হবে, যা নির্বাচনের ভিত্তি হবে। ড. ইউনূস বলেন, কমিশন প্রতিবেদন জমা দেওয়ার মাধ্যমে নতুন এক অধ্যায় শুরু হলো এবং তারা সকলের মতামত নেওয়ার মাধ্যমে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করতে চান। তিনি উল্লেখ করেন যে, এই সনদটি বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সবার সম্মতির ভিত্তিতে বাস্তবায়িত হবে।
তিনি আরও বলেন, এই চার্টারই বাংলাদেশের উন্নতির পথপ্রদর্শক হবে এবং নির্বাচনও এর ভিত্তিতে হবে। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, এই সনদ কোনো দলীয় কমিটমেন্ট নয়, বরং এটি জাতীয় কমিটমেন্ট।
ইউনূস বলেন, গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন সবার সঙ্গে একত্রিত হয়ে বাস্তবায়িত হবে, এবং ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হলে এই চার্টার হারিয়ে যাবে।
এছাড়া, তিনি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনকে ঐতিহাসিক ঘটনা বলে বর্ণনা করেন, যা দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক পটভূমি তৈরি করেছে।
সংবিধান, দুদক, পুলিশ এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারে গঠিত কমিশন ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে নিজেদের সুপারিশ জমা দিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে পাঁচ মাস ধরে চলমান সংস্কারের ধারাবাহিকতায় চারটি কমিশন (সংবিধান, নির্বাচন, পুলিশ এবং দুর্নীতি দমন) তাদের সুপারিশ পেশ করেছে। এসব প্রস্তাব শাসন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে।
সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবনায় জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও বহুত্ববাদকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সংসদ ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে ৪০০ সদস্যের নিম্নকক্ষ এবং ১০৫ সদস্যের উচ্চকক্ষ গঠন করার কথা বলা হয়েছে।
নির্বাচনী সংস্কার কমিশন নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে। “না ভোট” পুনরায় চালু, ৪০ শতাংশের কম ভোট হলে পুনরায় নির্বাচন আয়োজন করা, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন- ইভিএম পরিহার, ব্যয়ের সীমা নির্ধারণ এবং প্রার্থীদের আর্থিক হিসাবের নিরীক্ষার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ সীমিত করা, সংসদ সদস্যের বয়সসীমা ২১ বছরে নামানো এবং স্থানীয় সরকার কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
এদিকে দুদক সংস্কার কমিশন দুদককে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে জাতীয় কৌশল প্রণয়ন প্রস্তাবিত হয়েছে।দুদকের কমিশনার সংখ্যা বাড়িয়ে পাঁচজন করা, মেয়াদ চার বছরে নামানো এবং নিয়োগের জন্য একটি স্বাধীন অনুসন্ধান কমিটি গঠন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, পুলিশ সংস্কার কমিশন মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধে স্বচ্ছ ব্যবস্থা এবং নজরদারির ওপর জোর দিয়েছে। হেফাজতে নির্যাতন বন্ধে স্বচ্ছ দেয়ালযুক্ত কক্ষ এবং জিপিএস ও বডিক্যাম ব্যবহারের প্রস্তাবও রাখা হয়েছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমিয়ে, একজন ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় রাজনৈতিক দলের প্রধান বা সংসদ নেতা হতে পারবেন না-এমন প্রস্তাব রেখেছে।
এছাড়া, সংবিধানের নাম পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি থেকে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রকে নতুন মূলনীতি হিসেবে আনা হয়েছে।
কমিশন দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা প্রস্তাব করেছে, যার মধ্যে নিম্নকক্ষে ৪০০ সদস্য এবং উচ্চকক্ষে ১০৫ সদস্য থাকবে। রাষ্ট্রপতির মেয়াদ চার বছর এবং তিনি দুবারের বেশি নির্বাচিত হতে পারবেন না।
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন ও অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যবস্থা নিয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। স্থানীয় সরকারের শক্তিশালীকরণের জন্য স্বায়ত্তশাসন বৃদ্ধির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছিল এক রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে। যে আন্দোলনের মূল লক্ষ্যই ছিলো বাংলাদেশের সমস্ত রাষ্ট্রিয় কাঠামোগুলো কে পরাধীনতার জিঞ্জির থেকে মুক্ত করে শক্তিশালী স্বাধীন সার্বোভৌম রাষ্ট্র গঠন করা।
(এএ/ ফারহানা সুমনা