চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে সামনের সারিতে ছিলেন যেসব মেয়ে, একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁদের দেওয়া হলো ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ তকমা। এখনো রক্তের দাগ শুকায়নি। কিছুদিন আগেই যারা ছিলেন আন্দোলনের সামনের সারির, তাদের আজ স্বৈরাচারের দোসর বলা হচ্ছে। বিষয়টি ছাত্রীদের জন্য অপমানজনক।
জানা গেছে,‘জননেত্রী শেখ হাসিনা হল’ এর সামনে বিগত প্রশাসনের আমলে নৌকার আদলে একটি বসার স্থান তৈরি করা হয়। তিনটা হলের ছাত্রীদের সময় কাটানোর কমন স্পেস ছিল এটি। ৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ছাত্রদের একটি দল ওই স্থাপনা ভাঙতে যায়। তাদের দাবি, পতিত আওয়ামী লীগের কোনো চিহ্ন ক্যাম্পাসে রাখা যাবে না। কিন্তু হলের ছাত্রীদের দাবি ছিল, এসব ভাঙলে প্রশাসনই ভাঙুক এবং ওই স্থানে বিকল্প বসার জায়গা বানিয়ে দিক।
৫ ফেব্রুয়ারি প্রায় মধ্যরাতে একদল ছাত্র স্থাপনাটি আবার ভাঙতে যান। তখন ছাত্রীদের সঙ্গে তাঁদের বাগ্বিতণ্ডা ও হাতাহাতি হয়। এ সময় ছাত্রীদের বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করেন ও নানা তকমা দেন ভাঙচুরকারীরা।
ছাত্রীরা সে সময় প্রক্টরিয়াল টিমকে বারবার ফোন করেও ঘটনাস্থলে পাননি। একপর্যায়ে মেয়েরা হল থেকে বের হয়ে ভিসির বাসভবনের দিকে যান প্রতিবাদ জানাতে। প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা সেখানে হাজির হলে ছাত্রীদের সঙ্গে তাঁদের তর্কাতর্কি হয়।
ছাত্রীদের অভিযোগ প্রক্টরিয়াল টিমের একজন শিক্ষক বিক্ষুব্ধ ছাত্রীদের গালিগালাজ করেন। ছাত্রীদের ‘ফ্যাসিবাদের দালাল, ‘হাসিনার লোক’ এসব ট্যাগ বা তকমাও দেন। এমন উত্তেজনাকর ও হাতাহাতির পরিস্থিতিতে ওই শিক্ষকের গায়ে হাত তোলেন এক ছাত্রী। এতে ছাত্রীদের ওপর নেমে আসে কঠোর শাস্তির খড়্গ। এর পরিপ্রেক্ষিতে শাস্তি হিসেবে সনদ বাতিলের সুপারিশসহ ১ জনকে আজীবন ও ৯ জনকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। যদিও অভিযুক্তদের মধ্যে কেউ কেউ তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিতও ছিলেন না।
পুরো ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব পাওয়া প্রশাসনকে দুষছেন সবাই। অভিযোগ উঠেছে, নিজেদের ক্ষমতাচর্চার সুবিধার্থে প্রশাসনে দায়িত্ব পাওয়া কতিপয় শিক্ষক একদল শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাসভিত্তিক কিছু সাংবাদিককেও নিজেদের দলে ভিড়িয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের অনেকে মনে করছেন, ক্যাম্পাসে একটি অবরুদ্ধ পরিবেশ তৈরির সংঘবদ্ধ প্রয়াস চলছে। যার ফলস্বরূপ ছাত্রীদের নিয়ে এমন ঘটনা ঘটল।
শিক্ষাজীবনের মাঝপথে এসে কঠোর শাস্তির মাধ্যমে তাঁদের ভবিষ্যৎ জীবনকে যেভাবে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, তা আসলে কতটা ন্যায্য, সেই প্রশ্নও উঠেছে।
শাস্তি পাওয়াদের একজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জুলাই অভ্যুত্থানের একজন সমন্বয়ক সুমাইয়া শিকদারের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, নৌকার আদলের স্থাপনাটি সরাতে ও হলের নাম পরিবর্তন করতে হল কর্তৃপক্ষকে কয়েকবার মৌখিকভাবে ও দুইবার লিখিতভাবে জানিয়েছি। আমরা চেয়েছিলাম, ফ্যাসিবাদের এই প্রতীক প্রশাসনই ভাঙুক। কিন্তু সেটি তারা করেনি। উল্টো ‘মবকে’ প্রশ্রয় দিয়েছে।
এ ঘটনায় কিছু প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে, যেমন যেখানে রাত ৯টায় ছাত্রী হল বন্ধ হয়ে যায়, একদল ছাত্র কীভাবে প্রায় মধ্যরাতে সেখানে ঢুকলো?
ছাত্রীদের হলে মধ্যরাতে প্রবেশে বাধাঁ দেয়ার কাজটি ছিলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। অথচ কতৃপক্ষ সেটি না করে উল্টো অবস্থান নিয়েছে। স্থাপনাটি ভাঙতে বাধা দিয়ে ছাত্রীরা যদি ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ হয়ে যান, তা হলে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসকের নামে এত দিন হলটি রেখে দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কী তকমা দেওয়া যায়?
মেয়েদের বারবার মৌখিক ও লিখিত আবেদন সত্ত্বেও নৌকার আদলে সেই স্থাপনা না সরিয়ে মবের মাধ্যমে সমাধান করার চেস্টা করা হলো। অথচ প্রশাসনিকভাবে এটা সরিয়ে ফেলায় ছিলো সঠিক সমাধান।
ছাত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা ক্যাম্পাসের সাংবাদিকদেরও অপদস্থ করেছেন সেই রাতে। সাংবাদিকদের ভিডিও করতে বাধা দেওয়া হয়। ছাত্রীরা বলছেন, তাঁরা যে সাংবাদিক ছিলেন, সেটি বোঝার উপায় ছিল না। কারণ, তাঁদের গলায় কোনো আইডি কার্ড ছিল না। তা ছাড়া সাংবাদিকদেরও কেউ কেউ মেয়েদের অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছিলেন।
এ ঘটনায় ছাত্রীদের কোনো কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়নি, এমনকি প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেলেও শাস্তির বিষয়টি চিঠি দিয়ে জানানো হয়নি। ছাত্রীদের অন্যায্য শাস্তি দেওয়ার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ছাত্ররা।
ছাত্রীদের পক্ষে প্রতিবাদ জানানো ছাত্র দের উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ফেসবুকে লেখেন, ‘বিপ্লবীরা কি হানি ট্র্যাপে।’ তার মানে দাঁড়ায় ছাত্রীরা হানি ট্র্যাপে ফেলে তাঁদের পক্ষে প্রতিবাদী ছাত্রদের কথা বলতে বাধ্য করেছেন!
এর আগেও নারীদের নিয়ে একাধিকবার অশালীন বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। এভাবে যৌন হয়রানিমূলক বক্তব্য দেওয়া কোনো ব্যক্তি কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন? বিষয়টি ছাত্রীদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
ঘটনাকেন্দ্রিক নানা প্রশ্নই বলছে, ছাত্রীদের দেওয়া এ শাস্তি সুবিবেচনাপ্রসূত হয়নি। গণহারে ৯ জনকে দুই বছর বহিষ্কারাদেশ ছাড়াও মাস্টার্সের চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে দেওয়া এক শিক্ষার্থীর অনার্সের অর্জিত সনদ কেড়ে নেওয়া কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না।
বিশৃঙ্খলা ও নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের শাস্তি দিয়ে থাকে। সেটির মূল্য উদ্দেশ্যই হচ্ছে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে সংশোধন করা।
ঘটনা বিবেচনায় গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনের আশ্রয়ও নিতে পারে চাইলে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেটি না করে ছাত্রীদের শিক্ষাজীবন ধ্বংসের যে সিদ্ধান্ত নিল তারা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠাটাই স্বাভাবিক।একজন ছাত্র বা ছাত্রী কে প্রশাসন এমন কোনো শাস্তি দিতে পারে না যেন তার পুরো জীবন হুমকির সম্মুখীন হয়। দোষ করে থাকলে সংশোধনের ব্যবস্থা রেখে শাস্তি কার্যকর করা উচিৎ।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তে প্রতিষ্ঠানটিরই অনেক শিক্ষকও কঠোর সমালোচনা করেছেন। তাদের মধ্যে একজন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাইদুল ইসলাম।

