১৩ জুন ২০২৫, শুক্রবার

স্বাধীন দেশ সিকিম যেভাবে ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়ে গেল!

ফারহানা সুমনা
spot_img
spot_img

সিকিম নামটা এসেছে লিম্বু ভাষার সু-হিম শব্দ থেকে। জনশ্রুতি আছে ‘সু-হিম’ শব্দের অর্থ সুখের ঘর। চোখ জোড়ানো কাঞ্চনজঙ্ঘা, মন ভোলানো নদী-উপত্যকা, অর্কিড,বৌদ্ধ গুম্ফা,ছোট্ট গ্রাম্য জনপদ সিকিম।

সিকিম উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি স্থলবেষ্টিত রাজ্য এবং উল্লেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্র। সিকিমের রাজধানী শহর গ্যাংটক। আয়তনে ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম প্রদেশ এটি।এর উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তিব্বত। পূর্বে রয়েছে ভুটান। পশ্চিমে আছেনেপাল এবং দক্ষিণে ভারতের অপর একটি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ।

সিকিম বাংলাদেশের নিকটবর্তী ভারতের শিলিগুড়ি করিডোরের কাছাকাছি অবস্থিত একটি রাজ্য। এটি ভারতীয় রাজ্যগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা কম জনবহুল।

পূর্ব হিমালয় অঞ্চলের একটি অংশ সিকিম। এখানে আল্পাইন এবং উপক্রান্তীয় জলবায়ু দেখা যায়। জীব বৈচিত্র্যের জন্য সিকিম উল্লেখযোগ্য। সেইসাথে সিকিমে অবস্থিত কাঞ্চনজঙ্ঘা ভারতের সর্বোচ্চ এবং পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বত শিখর। রাজ্যের প্রায় ৩৫% এলাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা জাতীয় উদ্যান দ্বারা আচ্ছাদিত।

জানা হলো সিকিমের আদ্যপান্ত।এখন জেনে নেয়া যাক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পরাধীনতা বর ণের গল্প।সিকিম ছিল আয়তনে অতি ক্ষুদ্র একটা স্বাধীন দেশ। মাত্র ৭000 বর্গ কিলোমিটারের ছোট্ট একটা দেশ সিকিম। ব্রিটিশরা যখন ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যান তখনও সেই ছোট্ট দেশটি
স্বাধীন শাসক দ্বারা শাসিত হয়েছে।

সেই সিকিম স্বাধীনতা হারিয়েছে বিশ্বাসঘাতক
কিছু মানুষের কারণে। ইন্ডিয়ার দখলদারী চেতনা কিভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রকে পরাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল তার একটা জ্বলন্ত উদাহরণ সিকিম।একটা স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েও ধরে রাখতে না পারার যে ইতিহাস সবার জন্যই তা বড় লজ্জার উদাহরণ।

সেসময় সিককিমের স্বাধীন রাজাদের বলা হতো চুগিয়াল। ভারতে ব্রিটিশ শাসন শুরুর আগে পাশের নেপাল আর ভুটানের সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীন অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল সিকিম।

ব্রিটিশরা বেশ কয়েকবার সিকিমের সার্বভৌমত্বে আঘাত করেছিল। সিকিমের স্বাধীন অস্তিত্বে তাদের আপত্তি না থাকলেও তিব্বতে যাওয়ার জন্য সিকিম দখল করে নিয়েছিল ব্রিটিশরা।
এমনকি সেসময় সিকিমের রাজা নামগোয়ালকে বন্দীও করা হয়।

অবশ্য ১৮৯২ সালে ব্রিটিশরা রাজা নামগোয়ালকে মুক্তি দেয় এবং সিকিমের স্বাধীনতাকে পুনরায় মেনে নেয়। একসময় সিকিমের স্বাধীন রাজা তথা চগিয়াল হয়ে আসেন থাসি নামগয়াল। তার শাসনকালেই ভারত ছেড়ে চলে যায় ব্রিটিশরা। সেসময় ভারত ও পাকিস্তান আলাদা হয়ে যায়।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা যখন উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যায় তখন সিকিম ভারতের সাথে যুক্ত হতে ইচ্ছুক কিনা? এ প্রশ্নে গণভোট হয়। গণভোটে জনতা ভারতকে প্রত্যাখ্যান করে এবং পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সিকিম তার যাত্রা অব্যাহত রাখে।

যদিও তিন দশক যেতে না যেতেই বিশ্বাসঘাতকতা আর ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে সিকিম।অন্যদিকে চোগিয়ালের সরলতার সুযোগে সিকিম হয়ে ওঠে ভারতের অঙ্গরাজ্য।

সেসময় গণভোটের রায় ছিল স্পষ্ট। ভোটের মাধ্যমে জনগণ বুঝিয়ে দিয়েছিল, ভারতের সঙ্গে যুক্ত নয় বরং স্বাধীন ভূখণ্ড হিসেবে থেকে যেতে চায় সিকিম। ভারতের নেতা জহরলাল নেহেরু সেসময় সিকিমকে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে মেনেও নেন। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টায় ঠাসী নামগোয়াল আর নেহেরু মারা যাবার পর। সিকিমের নতুন যোগিয়াল হন পান্ডেল থন্ডরূপ নামগোয়াল।

সেসময় ভারতে শুরু হয়েছে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর শাসন। ইন্দিরা গান্ধী সিকিমের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেননি কখনও। ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী সিকিম দখল করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। সিকিমের প্রধানমন্ত্রী তখন ছিলেন কাজী লেন্দুক দর্জি।

র এর মাধ্যমে দর্জিকে কিনে ফেলে ভারত। র এর তৎকালীন পরিচালক অশোক রায়নার লেখা ইনসাইড র বইতে সিকিম নিয়ে ইন্ডিয়ান ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যায়। বইটি থেকে জানা যায় ১৯৭১ সালে সিকিম দখলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় ভারত।

এরপরে কেটে যায় দুই বছর। র তার নিজের মত করে প্রেক্ষাপট দাঁড় করায়।সে সময় সিকিম দখলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ভারতের বর্তমান নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। সে সময় অজিত ছিলেন র এর একজন এজেন্ট।

সিকিম দখল করতে ভারতের কৌশল ছিল লেনদুপ দর্জিকে ঘিরে।ভারত লেন্দুক দর্জিকে দিয়ে সিকিমকে অস্থীতিশীল করে । সিকিমের জনগণের মাঝে সন্দেহ অবিশ্বাস ও বিভক্তি সৃষ্টি করে । লেন্দু দর্জি ভারতীয় এজেন্ডা ঠিকঠাক মতোই বাস্তবায়ন করে চলছিলেন। তিনি তখন দিল্লির ল্যাসপেন্সারে পরিণত হন।

দর্জি নিজ দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে সিকিমের ভবিষ্যৎ তুলে দেন ভারতীয়দের হাতে। ১৯৭০ সালে নেহরু প্রভাবিত সিকিম
ন্যাশনাল কংগ্রেসকে ব্যবহার করে।
এসময় সিকিমে ভয়াবহ অরাজকতা সৃষ্টি করে লেন্দুক দর্জি ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রএর
এজেন্টরা ন্যাশনাল কংগ্রেসের মাধ্যমে সিকিমের নেপালি হিন্দুদেরকে বৌদ্ধ যোগিয়ালদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে।

নেপালি হিন্দুরা রাজতন্ত্র অবসানের দাবিতে সোচ্চার হয়। পরিস্থিতিকে এতটাই ঘোলাটে করে ফেলা হয় যে সিকিমের অভিজাত হিন্দু সমাজ ভাবতে শুরু করে বৌদ্ধ রাজাদের অধীনে থাকার চেয়ে ভারতীয় হয়ে যাওয়াটাই ভালো হবে।

এদিকে ১৯৭৩ সালে নির্বাচনে পরাজিত হলেও ফলাফল মানেনি দর্জির দল সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস। র এর মদদে তারা সিকিম জনতা
কংগ্রেস নামের অপর একটি দলকে নিয়ে দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে।

এই আন্দোলনটি এক পর্যায়ে রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনের রূপ নেয়। এমন ভজঘট পরিস্থিতিতে ভারতের সাহায্য চান সিকিমের যোগিয়াল। দিল্লি এই সুযোগ লুফে নেয়।

সিকিমকে চাপে ফেলে যোগিয়ালের ক্ষমতা কাঠ সাট করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয় ভারতের সম্মতিতে। নয়া সংবিধান অনুসারে প্রায় সব ক্ষমতায় চলে যায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে।

১৯৭৪ সালে সিকিমে ফের ভোট হয়। দর্জির সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্লামেন্টের ৩২ আসনের মধ্যে ৩১টি আসনে জয় পায়। লেন্দু দর্জি হন সিকিমের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু
তখনো চুগিয়াল সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে রয়ে যান।

২৭মার্চ ১৯৭৫সালে প্রথম কেবিনেট মিটিংয়ে প্রধানমন্ত্রী লেনদুতুব দর্জি রাজতন্ত্র বিলোপ করেন এবং জনমত যাচাইয়ের জন্য গণভোটের সিদ্ধান্ত নেন। ততদিনে নতুন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সিকিমে ভারতীয় সেনাবাহিনী স্থায়ী ঘাঁটি গেড়ে ফেলে।

১৪ এপ্রিল ১৯৭৫ সালে সিকিমে ভারতীয় সেনাদের ছত্রছায়ায় এক সাজানো গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। স্বাভাবিকভাবে রায় আসে রাজতন্ত্রের বিপক্ষে। ৬এপ্রিল ১৯৭৫সালের সকালে সিকিমের রাজা তথা জগিয়াল যখন নাস্তার টেবিলে তখনই ভারতীয় সৈন্যরা রাজপ্রাসাদ ঘিরে ফেলে।এসময় রাজাকে বন্দি করে প্রাসাদ দখল করে নেয় তারা।

২৬ এপ্রিল ১৯৭৫ সিকিম অফিশিয়ালি ভারতের ২২ তম প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। লেন্দু দর্জিকে করা হয় সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী। বিলুপ্ত হয় যোগিয়াল পদ।

এরপর লেন্দু দর্জির রাজনৈতিক দলটি ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেস দলের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। এভাবেই নিজের দেশের মানুষের বিশ্বাসঘাতকতায় একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ভারতের অধীনে চলে যায়।

সাংবাদিক সুধীর শর্মা নেপালের কান্তিপুর পত্রিকায় পেন অফ লুজিং এ ন্যাশন নামে ২০০৭ সালের দিকে একটি কলামে লিখেন ভারত তার স্বাধীনতার গোড়া থেকেই সিকিম দখলের পরিকল্পনা করেছিল। ভারতেরপ্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু অনেকের সাথে কথোপকথনে তার ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন।

লেন্দুকদর্জি নিজেই তাকে বলেছেন ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর লোকেরা বছরে দু তিনবার তার সাথে দেখা করে পরামর্শ দিত কিভাবে আন্দোলন পরিচালনা করা যাবে।

এভাবেই একটা পরিকল্পিত চক্রান্ত ও দীর্ঘমেয়াদী ষড়যন্ত্রের জালে আটকে ফেলে, সিকিম কে
ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করা হয়।ভারত তার সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের কারণে প্রতিবেশী বিভিন্ন ছোটো ছোটো রাষ্ট্রের ওপর ভু-রাজনৈতিক চাপ অব্যাহত রেখেছে। সিকিম সে সকল দেশের জন্য
রাজনৈতিক উদাহরণ হিসেবে ভীতি সৃষ্টির কারণ হতেই পারে!

সর্বশেষ নিউজ