মোজাফফর হোসাইন
কদিন ধরে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে প্রশ্নটা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো না থাকলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে? হ্যাঁ, অনেক
মানুষ কর্মসংস্থান হারাবে, তবে তার জন্য উত্তম বিকল্পও আছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে গবাদিপশু, কিংবা ফলফলাদির খামার করে দেওয়া যেতে পারে। যেমন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হবে উচ্চতর আমের খামার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হবে উচ্চতর গবাদিপশুর খামার, মৎসখামার হবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, ছত্রাক বা সান্ডা খামার হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মেহেরপুরে নবনির্মিতি বিশ্ববিদ্যালয়টি হতে পারে ব্লাক বেঙ্গল ছাগলের। ইত্যাদি ইত্যাদি। এই মুহূর্তে ডিগ্রিধারী উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার চেয়ে গরুছাগল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের আপত্তির কারণ দেখি না। কারণ, আমি হিসাব করে দেখেছি, এতে তারা অর্থনৈতিকভাবে আরো লাভবান হবেন। আরো বেশি সম্মানিতও হবেন। কারণ আমাদের সমাজে যার টাকা আছে তার সম্মান বেশি। লাভবান কীভাবে হবেন বলছি। এখন শিক্ষকরা রাতের অন্ধকারে শিক্ষার্থী বিক্রি করতে পারেন না। কিন্তু খামার হলে একটা গরু বা ছাগল বা এক-গাছের আম রাতের অন্ধকারে বিক্রি করে তারা লাভবান হতে পারবেন। এবং দিনের বেলায় ভালোমতো ধম্মকম্ম করতে পারবেন। দুই, যিনি ভিসি হবেন তাকে ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে পালাতে হবে না। তিন, প্রমোশনের জন্য অধ্যাপকদের জার্নালে গবেষণা আর্টিকেল লেখার প্যারা থাকবে না। বইপত্র পড়া লাগবে না।
আপনাদের আস্বস্ত করছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে না থাকলে শিক্ষার্থীদেরও ক্ষতি হবে না। আমি নিজের উদাহরণ দিই। ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম সাহিত্য বিষয়ে উচ্চতর জ্ঞানের জন্য। কিন্তু দেখা গেল, আমার কোনো কোনো শিক্ষকই সাহিত্যবিরোধী। আবার সহপাঠীদের কেউ কেউ ইংরেজি ভাষা শেখার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু, ছয় বছর পর দেখা গেল সে যা ইংরেজি শিখেছে, আমার বাচ্চা ইংরেজি মিডিয়াতে পিজিতেই সেটা শিখে ফেলেছে।
আর যারা কিছু শেখার উদ্দেশ্যে না, শুধু চাকরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চান, বলা বাহুল্য তাদের সংখ্যা সিংহভাগ, তাদের জন্য সুখবর হলো, এক্ষেত্রে ইন্টারমিডিয়েট পাশের পর শিক্ষার্থীরা পিএসসি, বিসিএস পরীক্ষাগুলো দেওয়ার সুযোগ পাবে। বলে রাখি, উচ্চমাধ্যমিকের পর সরাসরি বিসিএস ও পিএসসি’র এক্সাম হলে শিক্ষার্থীদের জন্য সুবিধাও হবে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপরীক্ষা আর চাকরির পরীক্ষা প্রায় একই প্রশ্নে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সাবজেক্টের ছাত্রদের মূল উদ্দেশ্য যদি হয় ব্যাংকে কিংবা প্রশাসনে চাকরি করা, তাহলে মাঝখানে ৬টা বছর ব্যয় করার দরকার কি? অর্থের অপচয়, সময়ের অপচয়, এনার্জির অপচয়। এই বন্দোবস্তে আইএ পাশ লোকজন সরকারি বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে চাকরি করবে।
এখন পণ্ডিতরা প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে ব্যাংকের ম্যানেজার বা সচিব হবেন কারা? আইএ-পাশ যারা তারা কি প্রতিষ্ঠান প্রধান হবেন?
হলে ক্ষতি নেই। তবে না হওয়া উত্তম। ডিসিশন মেকিং পোস্টগুলোতে বিদেশি দক্ষ লোক নিয়োগ দিতে হবে। জেন জি বাংলাদেশের প্রধান ব্যক্তিত্ব (সাইলেন্ট জেনারেশন) ড. ইউনূস যেমনটি বলেছেন, ”(বন্দর ব্যবস্থাপনা) বিশ্বের সেরা যারা তাদের হাতে তুলে দিতে হবে, যেভাবেই হোক।” সেটা সকল ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক হতে পারে। কারণ তাতে সুবিধা দুটো, বিদেশি লোকরা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধানের চেয়ারে বসে কিংবা অর্থমন্ত্রণায়ের সচিব হয়ে, অথবা পুলিশের আইজি হয়ে দলীয় রাজনীতি করবেন না। দুই বিদেশি লোকরা দেশি শিক্ষিতদের মতো ঘুষবাণিজ্য করবেন না। বোনাস সুবিধা, বিদেশি নাগরিকের সেলারির অর্থটাই শুধু দেশের বাইরে যাবে, অতিরিক্ত অর্থপাচার হবে না, যেমনটি আমাদের বেনজীররা করে থাকেন। তাছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ হলে সরকারের যে মোটা অংকের অপচয় রোধ হবে, তার এক পার্সেন্ট দিয়েই মোটা মাইনে দিয়ে বিদেশি লোক রাখা যাবে। এই বন্দোবস্তের বাড়তি সুবিধাও আছে, এতে অর্থমন্ত্রণালয়ের সচিব কখনোই সংস্কৃতি সচিব হবেন না। ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব কখনোই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবেন না। এই পদগুলো হবে এক্সপার্ট, অরাজনৈতিক এবং নৈতিক লোকদের জন্য।
আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে দেশের মেধাবীদের কি হবে? Well, যারা নিজেদের মেধাবি দাবি করবেন, হয়তো মেধাবিও, তাদের আমরা দেশে না রেখে বিদেশে রপ্তানি করব। এতে তাদের যেমন উপকার, দেশেরও উপকার। কারণ প্রায় প্রমাণিত সত্য যে, দেশে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার পর কর্মজীবনে গিয়ে মেধাবিরা নষ্ট হয়ে যান, পচে যান, তাদের মেধা থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়। যে প্রতিষ্ঠানে যান, সেই প্রতিষ্ঠানে চুরিচামারি করে নষ্ট করে দেন। ফলে তাদের বিদেশে রপ্তানি করলে তাদের মেধা যেমন নষ্ট হবে না, বরঞ্চ আরো শানিত হবে; প্লাস পাশাপাশি তাদের মাধ্যমে দেশের রেমিটেন্স বৃদ্ধি পাবে।
আমার দীর্ঘ গবেষণা থেকে আপনাকে নিশ্চিত করতে পারি, বাংলাদেশ চালানোর জন্য গড়মেধাবিরাই যথেষ্ট। নিম্ন মেধা হলে আরো ভালো। কারণ, এটাও প্রমাণিত সত্য, মেধার সঙ্গে দুর্নীতি ও জোচ্চুরির সম্পর্ক সমানুপাতিক। যত মেধা তত দুর্নীতি। তাত্ত্বিকভাবে না হলেও প্রাকটিকালি এদেশে সেটাই ঘটেছে। আপনারা নিশ্চয় মানবেন, বাংলাদেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করেছে নিরক্ষর কৃষক মজুররা না। বাংলাদেশকে আইন, আদালত করাপ্ট করেছে স্কুলফেল রিকশাচালকরা না। এদেশের সমস্ত নষ্টের মূল উচ্চশিক্ষিতরা। এটা শুনে বর্তমান উচ্চশিক্ষিতরা মন খারাপ করবেন না। কারণ এটা শুধু সমকালীন না, ঐতিহাসিক সত্যও। আপনার অগ্রজ উচ্চশিক্ষিতরাও একই কাজ করেছেন। সেই ১৯৭৫ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান (আপনার অনুভূতি ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে ভেবে নামটা উল্লেখ করছি না) জাতীয় সংসদে বলেছিলেন ”করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিতসমাজ। যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি। আজ যেখানে যাবেন, করাপশন দেখবেন- আমাদের রাস্তা খুঁড়তে যান- করাপশন। খাদ্য কিনতে যান- করাপশন। জিনিস কিনতে যান- করাপশন। তারা কারা? আমরা যে ৫ শতাংশ শিক্ষিত সমাজ, আমরা হলাম দুনিয়ার সবচেয়ে করাপ্ট পিপল, আর আমরাই করি বক্তৃতা।” কাজেই আমরা যেহেতু প্রত্যক্ষভাবে করাপশন বন্ধ করতে পারব না, তাই উচ্চশিক্ষার সুযোগ বন্ধ করে পরোক্ষভাবে করাপশন কমিয়ে আনতে পারি।
কারণ, আপনারা নিশ্চয় মানবেন পিএইচডি ধারী কর্মকর্তা বেনজীরের চেয়ে আমার গ্রামের মকলেস বেশি সৎ? হয়তো বলবেন, মকলেস তো পকেট মারে, সুযোগ পেলে সেও বেনজীর হবে। জ্বি না স্যার। মকলেস একদিনে একটা পকেট মারতে পারলে নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়। তিন দিন পরের হিসাব করে না। সে বেনজীর, মতিউর স্যারদের মতো দেশে বিদেশে হাজার বিঘা জমির বিভাগ মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখে না। বেশি শিক্ষা বড়ো চোর বানায়, অল্প শিক্ষা ছোটো চোর করে। আমাদের এই মুহূর্তে ছোটো চোর দরকার। বিশেষত হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে বিশ্ববিদ্যালয় চালিয়ে বড়ো চোর উৎপাদন করা যৌক্তিক কাজ হতে পারে না। এটা নিশ্চিয় পাগলেও মানবে।