বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) ঢাকা কেন্দ্র থেকে শিল্পী সম্মানীর ১০ লাখ ৪৪ হাজার ৭৯৬ টাকা আত্মসাৎ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত পরিচালক (অনুষ্ঠান) জগদীশ চন্দ্র এষ। তার চুক্তি শেষ হওয়ায় তিনি টাকাগুলো নিয়ে বিটিভি ছেড়েও গেছেন। আত্মসাৎকৃত টাকা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে ফেরত দিতে বললেও তিনি আমলে নেননি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিটিভির ঢাকা কেন্দ্রের শিল্পী সম্মানী খাত হতে পরিচালক ( অনুষ্ঠান ও পরিকল্পনা) জগদীশ চন্দ্র নিজ নামে বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে বিভিন্ন সময় এই ১০ লাখ ৪৪ হাজার টাকার চেক নিয়েছেন। যা বিটিভির একজন পরিচালক হয়ে নিজ নামে এই টাকা নিতে পারেন না। অর্থাৎ বিটিভির কোনো কর্মকর্তা নিজ নামে শিল্পী সম্মানীর চেক নিতে পারেন না।
প্রতারণা করে শিল্পী সম্মানী আত্মসাৎ করার ঘটনায় শিল্পীদের পক্ষ থেকে সংগীত শিল্পী মীর শরীফ হাসান লেলিন (৪৬) মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগ দায়ের করেন। যার তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এমনকি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ও তদন্ত করে প্রমাণ পেয়েছে টাকা আত্মসাতের।

পিবিআইর তদন্ত প্রতিবেদন, আত্মসাতকৃত টাকা ফেরত দিতে মন্ত্রণালয়ের তাগাদা চিঠি ও জগদীশ চন্দ্র এষের অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে বিটিভি কর্তৃপক্ষ যেসব চিঠি চালাচালি করেছে তা এইদিন এইসময়’র হাতে এসেছে।
পিবিআইর তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ‘জগদীশের বিরুদ্ধে বাদীর (মীর শরীফ হাসান লেলিন) আনিত পেনাল কোডের ৪২০/৪০৬ ধারার অপরাধ প্রাথমীকভাবে সত্য বলে প্রমাণিত হয়। তবে তদন্তকালে পেনাল কোডের ৪৬৮/৪৭১/৫০৬ ধারার অপরাধের স্বপক্ষে কোন সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। মামলায় দাখিলকৃত কাগজপত্র তদন্তের সত্যতা প্রমাণে সহায়তা করবে। বাদীকে পিটিশন মামলার তদন্তের ফলাফল জানানো হয়েছে।’
বিটিভি সূত্রে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়েছে জগদীশ চন্দ্রে বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে। বিটিভি ঢাকা কেন্দ্র খুব শিগগিরই পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১ মে থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিটিভির ঢাকা কেন্দ্রের শিল্পী সম্মানী খাত হতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের গবেষণা ও রয়্যালিটি বাবদ ১০ লাখ ৪৪ হাজার ৭৯৬ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। মন্ত্রণালয় থেকে এই টাকা সরকারের কোষাগারে বার বার জমা দিতে বললেও আজ পর্যন্ত তিনি টাকা জমা দেননি। অথচ তার নিয়োগের চুক্তি শেষ হয়েছে গত জুন মাসের ১৫ তারিখ।
এছাড়া জগদীশ চন্দ্রের বিরুদ্ধে অনুমতি ছাড়া বিদেশ গমনেরও অভিযোগ রয়েছে।
বিটিভি সূত্রে জানা গেছে, তার (জগদীশ চন্দ্র এষ) কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করে মাসের পর মাস কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। নিজের ইচ্ছামাফিক অফিস করতেন।
জগদীশের তত্ত্বাবাধনে নির্মিত অনুষ্ঠানগুলোর ব্যয় বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তিনি ২০২২ সালে ১৭৫ পর্বের অনুষ্ঠান নির্মাণে ব্যয় করেছেন ৫৭ লাখ ৯০ হাজার ৫৯০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি পর্বে গড়ে ব্যয় করেছেন ৩৩ হাজার ৮৯ টাকা।
অন্যদিকে তার (জগদীশ চন্দ্র এষ) তত্ত্বাবাধন ছাড়া বিটিভির নিজস্ব প্রযোজকদের মাধ্যমে ২০২৩ সালে ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ১৮৭ পর্ব অনুষ্ঠানে ব্যয় হয় ৫১ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭৩ টাকা। প্রতি পর্বে গড় ব্যয় ২৭ হাজার ৬৮৪ টাকা। অর্থাৎ জগদীশ চন্দ্র এষ’র তত্ত্বাবাধনে প্রতিপর্বে গড় ব্যয় বেশি হয়েছে পাঁচ হাজার ৪০৫ টাকা। বিটিভির নিজস্ব প্রযোজকদের মাধ্যমে মাসিক সাশ্রয় হয়েছে ৩ লাখ ১৫ হাজার ২৯১ টাকা।
এ হিসেবে জগদীশ চন্দ্র এষ তার চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগকালীন সময় (৫ বছর) বিটিভির (ঢাকা কেন্দ্র) অতিরিক্ত ব্যয়ের হিসেব দিয়েছেন ১ কোটি ৮৯ লাখ ১৭ হাজার ৪৬০ টাকা।
উল্লেখিত বিশ্লেষণ বলছে, জগদীশ চন্দ্র তার দায়িত্ব অবহেলা করে প্রতিষ্ঠানটির অর্থ অপচয় করেছেন। আরও অভিযোগ উঠেছে এই ১ কোটি ৮৯ লাখ ১৭ হাজার ৪৬০ টাকা তিনি নানাভাবে আত্মসাৎ করেছেন। কিন্তু এ তথ্য নিশ্চিত হতে পারেনি এইদিন এইসময়।
জানা যায়, ২০২১ সালের ১৫ জুন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনমূলে ১৬ জুন তিন বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান জগদীশ চন্দ্র এষ। যোগদানের তারিথ হতে তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ চাকরির মেয়োদ শেষ হয়েছে চলতি বছরের ১৫ জুন। এর আগেও ২ বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন তিনি। মোট পাঁচ বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে ছিলেন তিনি।
জগদীশ চন্দ্র এষ যোগদানের পর থেকে বিটিভিতে অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। নিয়মিত দায়িত্বপালনের পাশাপাশি তিনি বিটিভির অনুষ্ঠান পরিচালনা করা কালীন বহিরাগত বিভিন্ন সংগীত শিল্পীদের অংশগ্রহণকৃত অনুষ্ঠানও তার দায়িত্বে পরিচালিত হতো। এসব অনুষ্ঠানের মধ্যে ১. স্বাস্থ্য জিজ্ঞাসা প্রতি মাসে ৮ পর্ব, ২. বিটিভি সংলাপ প্রতি মাসে ৮ পর্ব, ৩. নিশি গুণ গুণ প্রতি মাসে ২ পর্ব, ৪. এই সময় প্রতি মাসে ২২ পর্ব সহ প্রতি মাসে মোট ৭৫টি পর্ব, ৫. খবর প্রতিদিন মাসে ৩০ পর্ব, ৬. বিজনেস আপগ্রেড প্রতিমাসে ৪ পর্ব এবং বাংলাদেশের হৃদয় হতে প্রতি মাসে ৮টি পর্ব পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতেন এই পরিচালক।
প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী বহিরাগত শিল্পীরা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার পর তাদের নিজ নিজ পাওনা গ্রহণ করতেন। প্রতিটি অনুষ্ঠানের নির্ধারিতভাবে শিল্পী সম্মানী গ্রহণ করতেন। সম্মানীর অর্থ জগদীশ চন্দ্র এষ এর মাধ্যমে শিল্পীরা পেতেন। কিন্তু বিবাদী (জগদীশ চন্দ্র এষ) উল্লিখীত অনুষ্ঠানের শিল্পী সম্মানী প্রাপকদেরকে না দিয়ে নিজ নামে বিভিন্ন সময় চেক ইস্যু করে নিতেন।
এ বিষয় জানতে জগদীশ চন্দ্র এষের মোবাইলে গত দুইদিন একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে তার হোয়াটসঅ্যাপে এ বিষয় জানতে চাইলে তিনি অপ্রাসাঙ্গিক কথা বললেও সংশ্লিষ্ট অভিযোগের বিষয়ে কোনো উত্তর দেননি।
এ বিষয় বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) মহাপরিচালক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম এইদিন এইসময়কে বলেন, ‘জগদীশ চন্দ্রের চাকরির চুক্তি শেষ হওয়ার আগেই মন্ত্রলণালয়ের কাছে নির্দেশনা চেয়েছিলাম কীভাবে তার কাছ থেকে আত্মসাৎকৃত টাকা আদায় করব। মন্ত্রলণালয় জানিয়েছিল প্রচলিত আইনে টাকা আদায় করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘মন্ত্রলণালয় থেকে চিঠি দিয়ে আমাদের বলেছিলো তিনি (জগদীশ চন্দ্র এষ) যাতে টাকা ফেরত দিয়ে চালানের রশিদ মন্ত্রলণালয়ে পাঠায়। আমরা মন্ত্রণালয়েরে এই নির্দেশনা জগদীশ চন্দ্রকে দিয়েছি। কিন্তু তিনি আমাদের বলেছেন যে আমি মন্ত্রণলায় আবেদন করেছি, আমি বাড়তি টাকা নেইনি। কিন্তু এরমধ্যে জুন মাসে তার চাকরির মেয়াদ শেষ হয় যায়। তার (জগদীশ চন্দ্র) চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আমরা মন্ত্রণালয়কে আবারও জানিয়েছি যে তিনি টাকা ফেরত দেননি।’
ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের তদন্তেও প্রমাণিত হয়েছে তিনি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।’
বিটিভি মহাপরিচালক বলেন, ‘গতকাল বৃস্পতিবার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মন্ত্রণলালয়ের চিঠি পেয়িছি। ঢাকা কেন্দ্র থেকে যেহেতু তিনি টাকাটা নিয়েছেন এখন ঢাকা কেন্দ্রেরই দায়িত্ব জগদীশ চন্দ্রের কাছ থেকে টাকাটা ফেরত নিতে মামলা করা। এখন ঢাকা কেন্দ্রকে মামলা করার জন্য আগামীকাল (রবিবার) নির্দেশনা দিব।’

