আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে পনেরো বছরের শাসনামলে মানুষ তার অধিকারগুলো একে একে হারিয়ে ভিখিরির মতো হয়ে যাচ্ছিল। না ছিল কথা বলার স্বাধীনতা, না ছিল প্রতিবাদ করার সাহস। দিনে দিনে মানুষের বুকের ওপর পাথর চেপে বসেছিল। যার ওজন ছিল হিমালয় সমান। এই পাথর সরানো এতো সহজ ছিল না। কারণ সাধারণ মানুষের কাছে নেই অর্থ,নেই প্রশাসন, নেই সংগঠিত হবার সুযোগ।
কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী পতিত ওই সরকারের জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে একটা উপলক্ষ বেছে নেয়। সেটি হলো সরকারি চাকরিতে কোটা বৈষম্য। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। যেহেতু এটি সমগ্র দেশের ছাত্রদের অধিকার আদায়ে দাবি, ফলে তারা আন্দোলনে সমর্থন দেয়।
জূলাইয়ের একদম প্রথম দিন থেকে শিক্ষার্থীরা এক সুরে সারাদেশে অবস্থান কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের সূচনা করে। আর সেটি শেষ হয় এক দফায়। সেই এক দফা ছিল হাসিনার পদত্যাগ। আর এর জন্য জুলাই- আগস্ট সারাদেশে হাজার হাজার ছাত্র জনতার তাজা প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই আলোচনায় ছিলো এই ছাত্র জনতার আন্দোলনে মাষ্টারমাইন্ড কে?
সম্প্রতি জাতিসংঘের এক অধিবেশনের পর বিশ্বমঞ্চে মাহফুজ আলমকে নামে একজনকে জুলাই বিপ্লবের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনুস। এরপর থেকেই বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়।
যদিও “মাস্টারমাইন্ড” শব্দটির সঙ্গে একমত নন বলে জানিয়েছেন সমন্বয়ক তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম। তার মতে যে আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে, তাতে কোনো একক নেতৃত্ব ছিল না। মাস্টারমাইন্ড নিয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্লাটফর্ম সাধারণ শিক্ষার্থীদের জায়গা। এখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারাও ছিলেন। একটা সময় আন্দোলন পরিচালনা করতে অনেকেই বুদ্ধি পরামর্শ দিয়েছেন।
আমরা একদম শুরুর ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই,পর্যায়ক্রমে আন্দোলন কিভাবে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। ফলে তখনো একটি প্রশ্ন সবার মাঝে ছিল এই সফল আন্দোলনের নেপথ্যে কে?
নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি সর্বপ্রথম মধ্য জুলাইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেদিন ছাত্রলীগ হামলা করে, চশমা পরা একটা মেয়ের চোখ মুখ এমনকি সমস্ত শরীর গড়িয়ে রক্ত ঝরছিল। দৃশ্যটা হয়তো আমাদের সবারই মনে আছে। ঠিক ওইদিন থেকেই সারাদেশের বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নন পলিটিক্যাল শিক্ষার্থীরা ফেসবুকে পোস্ট করতে শুরু করে। তারা এই হামলার প্রতিবাদে রাজপথে থাকার অঙ্গীকার করেন।
এদিকে মধ্য জুলাইয়ে আন্দোলন যখন তীর খুঁজছিল ঠিক তখনই রংপুরে পুলিশের বুলেটে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবু সাঈদ দেশ মাতৃকার জন্য বুক পেতে দেন। সমগ্র বিশ্ব সাক্ষী কীভাবে আবু সাঈদকে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। অকুতোভয় সাহসী সূর্য সন্তান আবু সাঈদ ওইদিনই শহীদ হন। তার এই হত্যার ঘটনা সমগ্র দেশের তরুণ প্রজন্মের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। তারা শপথ করে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র করতে হবে।
আবু সাঈদের অটল বিশ্বাস সবার বুকে ধারণ করে নিয়ে রাজপথে নামে। আবু সাঈদ মৃত্যুকে উপেক্ষা করে জীবন উৎসর্গ করার কথা ভাবতে পেরেছিলেন বলেই, সেদিন আন্দোলনের সামনের
সারিতে এসে দাঁড়িয়ে যায় আওয়ামী লীগের কতিপয় দুর্বৃত্ত আর সুবিধাভোগী ছাড়া দেশের আপামর জনতা। আমি বলব, শহীদ আবু সাঈদই ছিলেন আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড। কারণ তিনি বুক পেতে মৃত্যু বরণ করে নেয়ার পর আর কেউ ঘরে থাকতে পারেননি। তার হত্যাকাণ্ডের পর ছাত্র জনতা তেজোদীপ্ত হয়ে ওঠে।
যদিও হাসিনা তখনও বুঝতে পারছিলো না ক্ষমতা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। হাসিনা সরকার তার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ছাত্র লীগ যুবলীগ, পেটুয়া বাহিনী দিয়ে আন্দোলন দমনের মিশন শুরু করে।কিন্তু সশস্ত্র বাহিনীর সাথে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের যুদ্ধটার ফলাফল এমন হতে পারে তিনি ভাবতেই পারেননি।
এতটা অসম যুদ্ধের সামনে গিয়ে বুক পেতে দিয়ে শহিদ হলো প্রায় দেড় হাজারের মত নিরস্ত্র মানুষ। আহত হলো বাইশ হাজারের বেশি। এখানে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি মানুষ তার লক্ষ্য ঠিক করে। প্রতিটি মানুষ ঠিক করে দেশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে তারা জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারে।
এভাবে অসংখ্য মানুষের আত্নত্যাগের চিন্তা থেকে, ভাবনা থেকে দুঃখী মানুষের দেশে নতুন এক স্বাধীনতা আসে।
সুতরাং আমাদের বিপ্লবের মাস্টার মাইন্ড কিছু ব্যক্তি অথবা রাজনৈতিক কোনো দল ছিলো না। আমাদের মাস্টারমাইন্ড ছিলো আমাদের শহিদেরা,আহত মানুষেরা। সাধারণ মানুষেরা যারা জীবন বাজি রেখে স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটিয়েছিলো।
কিছু মানুষ বা দল আলাদাভাবে নিজেদেরকে গুরুত্বপূর্ণ বা মাস্টারমাইন্ড ভাবতে চাচ্ছে, আবার কিছু ষড়যন্ত্র চলছে যেন মাস্টার মাইন্ড এর ধোঁয়া তুলে মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করা যায়।
এত বড় একটা আত্মত্যাগের পর অর্জিত সফলতাকে যত্ন করতে হবে। কোনো ষড়যন্ত্রের কারনে যেন তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হয়, সে জন্য অতন্দ্রপ্রহরীর মতো দায়িত্ব পালন করতে হবে। আর দেশ রক্ষার এ মিশনের দায়িত্ব পালন করার মাস্টারমাইন্ড ও আমাদের অর্থাৎ সাধারণ মানুষেরই হতে হবে।
(এইদিন এইসময়/জাকারিয়া শুভ)