ফ্যাসিজম বা ফ্যাসিবাদ কি? এই শব্দটি বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে। তবে গত জুলাইয়ের আন্দোলন থেকে এই ফ্যাসিস্টকে আমরা চিনতে পেরেছি। এর আরেক রূপ হচ্ছে স্বেচ্ছাচারিতা বা স্বৈরাচার। ফ্যাসিবাদ দর্শন সবকিছুকেই রাষ্ট্রের নামে নিজেদের অধীন বলে মনে করে। এখানে ভিন্নমতের কোনো ঠাঁই নেই। এ জন্য ফ্যাসিবাদে ভিন্নমতকে সহ্য না করে দমন করা হয়।
এই ফ্যাসিজম চালু রাখতে ফ্যাসিস্টরা আমলাদের ব্যবহার করেছে নির্লজ্জভাবে। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলাদের ফ্যাসিবাদের কারণে সরকার ১৫ বছর একচেটিয়া শাসন করার সুযোগ পায়। এ সময়ের মধ্যে দেশের সব ধরনের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের।
চাকরি নিয়োগ থেকে শুরু করে পদোন্নতি, বদলি কার্যক্রম সবকিছুই ছিলো সরকারের লালিত আমলাদের হাতে। কিছু আদর্শবান, যারা নীতির সাথে চলতো তাদের বিভিন্নভাবে হুমকি ও হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়েছে। চাকরি গেছে অনেকের।
চাকরিতে বৈষম্যের সঙ্গে আমাদের দেশের এই অতি বিকশিত এবং শক্তিশালী আমলাতন্ত্রের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। এই আমলাতন্ত্রের মধ্যে আবার বিশেষভাবে শক্তিশালী হলো প্রশাসন ক্যাডার। সরকারি সকল কর্মকর্তাদের মধ্যে সমতা বিধান করার
কথা সংবিধানে থাকলেও বিগত সরকারের আমলে কোথাও তা পরিলক্ষিত হয়নি।
প্রশাসন ক্যাডারে কর্মকর্তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সচিব, সচিব,অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদে অধিষ্ঠিত হয়ে থাকেন।
বিগত সরকারের ক্ষমতা ও দুর্নীতিতে সহযোগিতা করাই ছিলো এই আমলাদের রুটিন কাজ। সে সময় হাজার হাজার কোটি টাকায় দুর্নীতি হয়েছে তাদের স্বাক্ষরিত অনুমোদিত নির্দেশনায়। তারা একটি দলের ইচ্ছে মতো ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালসহ সাজানো নির্বাচনের নাটকটি মঞ্চায়নের কাজে সহযোগিতা করেছিলো জেলা ও উপজেলায় কর্মরত প্রশাসন ক্যাডারের রিটার্নিং অফিসার, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট,ও ম্যাজিস্ট্রেসির দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনাররা।
সরকার তার আমলাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে সমগ্র কাঠামোটি এমনভাবে সাজিয়েছিলো
যে তারা নির্লজ্জের মতো এমন ঘৃন্য কাজগুলো করেও জাতির সামনে লজ্জিত হয়নি কখনো। অথচ তারা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতন নেয়।
অভিযোগ আছে ২০১৪ সালে যে সব ডিসি এডিসি
ভুয়া নির্বাচন এর সমন্বয় করেছিলো তারাই এখন সচিব। অতিরিক্ত সচিব অথবা যুগ্ম সচিব হিসেবে কর্মরত আছেন।
জুলাই এর আন্দোলনে শুরু থেকেই দমনলীগ হিসেবে মাঠে ছিলো সরকারের ছত্রছায়ায় লালিত এইসব ক্যাডাররা। আন্দোলন দমনের নামে যে সহিংসতা করেছে সরকার তাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা ছিল প্রশাসনের কর্মকর্তাদের।
সরকার পতনের পর সর্বপ্রথম যে বিষয়টি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে সেটি হলো ফ্যাসিস্ট সরকারের পালিত আমলাবাহিনী।
সরকারের পুরো ব্যাবস্থাপনাকে ঢেলে সাজাতে না পারলে বিশেষ করে আমলাতন্ত্রকে পুর্নাঙ্গভাবে সংস্কার করা না গেলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে সফলভাবে সামনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান বলেছেন ‘ একজন অসৎ আমলা এক হাজার শয়তানের চেয়েও ভয়ংকর। ‘
সরকার পতনের পর অনির্বাচিত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগের ক্ষমতা সরকারের হাতে রাখা হয়। ১৯ৎআগষ্ট থেকে জেলা, উপজেলা, সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার জনপ্রতিনিধি অপসারণ করে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম-সচিব, বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি,জেলার স্থানীয় বিভাগের উপপরিচালক, অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এদেরকে নিয়োগ প্রদান করা হয়।
এখন প্রশ্ন হলো যাদেরকে নিয়োগ করা হলো, তারাইতো অপসারিত জনপ্রতিনিধিদেরকে নির্বাচিত করে পদে বসিয়েছিলো।সুতরাং যেটা হলো নতুন বোতলে পুরোনো মদ ফিরে এলো।
৫ আগষ্ট হাসিনা সরকার এর পতনের পরে ১৩ আগস্ট সরকারি একটা প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।প্রজ্ঞাপনে দেখা গেল ১৭৭জন প্রশাসনের কর্মকর্তা আগের কোনো তারিখের নির্দেশনা মেনে উপসচিব পদে পদন্নোতি পেলেন।১৪ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের ১৫ টি বিসিএস-এ বাদ পরা ২৫৯ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ দেয় সরকার।
১৮ আগষ্ট আরেকটি আদেশে ১৩ আগস্টে পদন্নোতিপ্রাপ্ত অনেক কর্মকর্তা ২০১জন যুগ্ম সচিব হিসেবে ভূতাপেক্ষ পদন্নোতির আদেশ জারি হয়।
১৭ আগষ্ট ৫কর্মকর্তা কে চুক্তি ভিত্তিক সচিব করা হয়।
এতো অল্প সময়ের মধ্যে এতোগুলো নিয়োগ এর বিষয়টি অনেকের কাছেই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়নি।ফ্যাসিজমের বীজ এদের মধে থেকে যাওয়ায় সম্ভাবনার কথা বলেছেন অনেকেই।
স্বৈরাচার সরকারের সাথে যে বা যারা সরাসরি যুক্ত ছিলো তাদের চাকরিচ্যুত না করে, আইনের আওতার মধ্যে না এনে বদলির মাধ্যমে বহাল তবিয়তে সম্মানিত স্থানে রেখে দেয়া হলো কেন? তার
পেছনে যুক্তি কি হতে পারে সেটাও সাধারণ মানুষের জানতে চাওয়ার বিষয়।
এ বিষয়ে বিএনপি সচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন ” সরকার ও আমলাদের মধ্যে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের অনেক প্রেতাত্মা অবস্থান করছে ।”
মনে রাখতে হবে, প্রশাসন খুব জটিল জায়গা এবং মন্ত্রণালয়ের মূল কাজগুলো করেন আমলারা।আমলারা যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের সঠিকভাবে গাইড না করেন বা সহযোগিতা না দেন তাহলে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টির আশংকা রয়েছে। সুতরাং রাষ্ট্র সংস্কারের প্রথম কাজ হলো আমলাতন্ত্র ঠিক করা। এখন প্রশ্ন থেকে যায় সংস্কারের কাজটি কে করবেন?
মন্ত্রণালয়ে এমন কাউকে দায়িত্ব দিতে হবে যিনি ব্যক্তি জীবনে সৎ। চাকরি জীবনে যার বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ ছিলো না। যিনি সাহসী এবং দেশের স্বার্থ বিবেচনায় যে কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
যোগ্য আমলাদের সাথে নিয়ে রাষ্ট্রের সংস্কারমূলক কাজে অগ্রসর হতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টার উচিৎ আমলাতন্ত্রকে গোছানোর কাজে হাত দেয়া।
যোগ্য, মেধাবী ও অভিজ্ঞ আমলাদের নিয়ে এমন একটি কাঠামো তৈরি করা যাতে দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব হয়। কারন আমলাতন্ত্র ঠিক করতে না পারলে সফল ও কাংখিত রাষ্ট্র আমরা তৈরি করতে পারবো না। আর এর সুযোগ নেবে সেই পুরনো শকুনগুলো।